ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শক সিনড্রোম দেখা দেয়ায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল থেকে গত ৮ আগস্ট একজন শিশুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তরের সুপারিশ করা হয়। কেননা ওই রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দেয়া জরুরি। অথচ ওই হাসপাতালে কোনো পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিআইসিইউ) নেই। তবে রোগীর স্বজনরা নানা চেষ্টা-তদবির করেও ঢামেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে কোনো বেড জোগাড় করতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়েই তারা পরে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে পিআইসিইউতে বেশ ক'দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ওই শিশুটি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। চিকিৎসকরা জানান, সময়মতো তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দেয়া না হলে তার জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ত। এমনকি এ সেবা দিতে কিছুটা বিলম্ব হলে ওই রোগী মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ারও আশঙ্কা ছিল।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শক সিনড্রোম দেখা দেয়ার পর এ ধরনের অনেক রোগীকেই বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। লিখিত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে দ্রম্নত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়ার। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, মিডফোর্ট, সোহরাওয়ার্দী, বক্ষব্যাধি ও পঙ্গু হাসপাতাল মিলিয়ে ঢাকার সরকারি হাসপাতালে যে সংখ্যক আইসিইউ রয়েছে তা খুবই নগণ্য। এর ওপর বেশির ভাগ আইসিইউ'ই অন্যান্য রোগে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর দখলে রয়েছে। অন্যদিকে স্কয়ার, ইউনাইটেড কিংবা অ্যাপোলোর মতো বেসরকারি উন্নতমানের
হাসপাতালের ব্যয়বহুল নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) রেখে রোগীর চিকিৎসা করানোর আর্থিক সামর্থ মধ্যবিত্ত পরিবারেরও নেই। তাই সেখানকার আইসিইউ বরাবরই রয়েছে বিত্তবানদের দখলে। ফলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়ার পর মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীরা বাধ্য হয়ে অনুন্নত বেসরকারি হাসপাতাল ও ছোটখাটো প্রাইভেট ক্লিনিকের আইসিইউতে ভর্তি হচ্ছেন। অথচ এসব আইসিইউর বেশিরভাগই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নেই। দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সেরও ব্যাপক সংকট রয়েছে। ফলে সেখানে চিকিৎসাধীন রোগী মোটা অংকের আইসিইউ বিল দিলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এদিকে পূর্ণবয়স্ক রোগীর জন্য যৎসামান্য আইসিইউ থাকলেও পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিআইসিইউ) আরও অপ্রতুল। অথচ এবারের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্রায় অর্ধেকই শিশু। যাদের একটি বড় অংশের চিকিৎসাধীন অবস্থায় শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, শক সিনড্রোমের চিকিৎসা আইসিইউতে করতে হবে। এটি বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া। রোগীকে পুরোপুরি অবজারভেশনে রাখতে হয়। এখানেও মূল চিকিৎসা স্যালাইন। কেননা শক সিনড্রোম হলে দ্রম্নতই শরীরে তরল পদার্থের সংকট দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুর শরীরে পানি, অন্যান্য তরল এবং জলীয় পদার্থ কম থাকে। তাই শক সিনড্রোমে তাদের শরীরে তরল পদার্থের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় এবং রক্তের পস্নাটিলেট কমতে থাকে। ফলে তাদের দ্রম্নত নিবিড় চিকিৎসা প্রয়োজন। অথচ পিআইসিইউ জোগাড়ে এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে তরল একেবারেই কমে যায় এবং মারাত্মক আকার ধারণ করে। এতে রোগীর মৃতু্য ঘটে।
বিষয়টি স্বীকার করে শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শরিফ আহমেদ মুয়াজ বলেন, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম যখন আসে তখন মাল্টিঅর্গান ফেইলিউর হয়ে যায়। তখন চিকিৎসকদের তেমন কিছু করার নেই। তখন আইসিইউ দরকার হয়। অনেক জায়গায় সেটা না থাকায় কিছু শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ জানান, ডেঙ্গুর সবচেয়ে জটিল অবস্থা হলো শক সিনড্রোম। পস্নাজমা লিকেজের কারণে ডেঙ্গু রোগীর যখন প্রেসার কমে যায়, নাড়ির গতি বেড়ে যায় ও নাড়ি দুর্বল হয়ে যায়, রোগী অচেতন হয়ে যায় বা অস্থির হয়ে যায়, তখন একে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গুর জটিলতা হিসেবে মস্তিষ্কে ইনফেকশন (এনসেফালোপ্যাথি), জিবিএসসহ জটিল স্নায়ুরোগ ও লিভার ফেইলিউরও হতে পারে। তবে এগুলো খুবই বিরল। এ অবস্থায় রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়। অথচ সরকারি হাসপাতালগুলোতে এ ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। পর্যাপ্ত আইসিইউ ও পিআইসিইউ থাকলে ডেঙ্গুতে মৃতু্যর হার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হতো বলে মনে করেন তারা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃতু্য হয়েছে, তাদের ৬৮ শতাংশেরই শক সিনড্রোম ছিল। এদের একটি বড় অংশ দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল।
এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আশঙ্কা, যে অর্ধলাখ ব্যক্তি এ বছর এরই মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের আগামী বছর আরও বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। অথচ এর ৫ শতাংশ রোগীর শক সিনড্রোম দেখা দিলে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় আইসিইউ কিংবা পিআইসিইউ নেই। ফলে আগামীতে মৃতু্য ঝুঁকি আরও বাড়বে। এ প্রেক্ষাপটে ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও পিআইসিইউ বাড়ানোর ব্যাপারে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মত দেন তারা।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রগুলো জানায়, আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী একটি সরকারি হাসপাতালে মোট বেডের ১০ ভাগ আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চলছে অরাজক অবস্থা। দেশের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এ হাসপাতালে মোট ৩ হাজার বেডের অনুপাতে ৩০০টি আইসিইউ বেড থাকার কথা; কিন্তু আছে মাত্র ২০টি। এ অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ থাকলেও আইসিইউয়ের বেড পেতে অনেক রোগীকে ২০-২৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়। বেড না পেয়ে স্বজনরা রোগীকে অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি করান।
এদিকে শুধু ঢাকা মেডিকেলেই নয়, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল, ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, নিউরোসায়েন্সেস, মিডফোর্ট হাসপাতালসহ বিভাগীয় শহরগুলোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধা নেই। আর জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়েও হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সগুলোতে যেখানে ঠিকমতো স্বাস্থ্যসেবাই পাওয়া দুষ্কর, সেখানে আইসিইউ সেবা চিন্তা করাও ভুল।
এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ কম থাকার কারণে পুকুরচুরি করছে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখেই সরকারের উচিত, ঢাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা বাড়ানো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রয়েছে ২৮টি বেড, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৯টি, জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালে ৮টি, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ৬টি, ঢামেকের বার্ন ইউনিট, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ বেড রয়েছে।
অন্যদিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬টি এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২ শয্যার আইসিইউ রয়েছে। রাজশাহী, রংপুর, গোপালগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউর সংখ্যা ১০টি। গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে ২টি করে বেড। শেখ আবু নাসের হাসপাতালে ৭টি এবং সাতক্ষীরা হাসপাতালে রয়েছে ৬টি বেড। দেশের ৩০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ৯টি ডেন্টাল কলেজের মধ্যে মাত্র ১৩টিতে আইসিইউ ইউনিট রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউর অপর্যাপ্ততা স্বীকার করে নিয়ে প্রশাসনের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ঢামেকে পর্যাপ্ত আইসিইউ বেড নেই। যে কয়টি আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। রোগীর অনুপাতে ঢাকা মেডিকেলে নূ্যনতম একশ' আইসিইউ বেড থাকা জরুরি।
এদিকে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে কেবল যে আইসিইউ বেড সংকট তা-ই নয়, লোকবল এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিরও ব্যাপক সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, শুধু আইসিইউ বেড পেলেই হবে না, আইসিইউর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল পেতে হবে। এখানকার জন্য দক্ষ জনবল, চিকিৎসক ও নার্স দরকার, যাদের আইসিইউতে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। পর্যাপ্ত আইসিইউ এবং পিআইসিইউ এবং এর দক্ষ জনবল বাড়াতে এখনই উদ্যোগ নেয়া না হলে আগামী বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেয়া আরও কঠিন হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন