রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গত বৃহস্পতিবার। এ ঘটনাকে ‘ওয়েক আপ কল’ বা সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। যদিও ঢাকার হাসপাতালগুলোর অগ্নিঝুঁকি নিয়ে এমন সতর্কবার্তা অনেক আগেই দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। সংস্থাটির প্রণীত ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালের তালিকায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ মোট ২৪৮টি হাসপাতালের নাম রয়েছে। এছাড়া অতিঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে ১৭৪টি হাসপাতাল।
ঝুঁকির তালিকায় থাকা হাসপাতালগুলোকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্নিঝুঁকি হ্রাসে কিছু পরামর্শও দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু এসব পরামর্শের কোনোটিই আমলে নেয়া হয়নি। এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ঘটে গেছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অন্য হাসপাতালগুলোয়ও যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৭ সালের প্রথমদিকে ঢাকাকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে সব ধরনের স্থাপনা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয় ফায়ার সার্ভিস। এর অংশ হিসেবে ঢাকার ৪৩৩টি হাসপাতাল পরিদর্শন করা হয়। মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, স্মোক/হিট ডিটেক্টর, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখে ঝুঁকি নিরূপণ করা হয় হাসপাতালগুলোর।
পরিদর্শন শেষে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিস। প্রতিবেদনে ২৪৮টি হাসপাতালকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ১৭৪টিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে—ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেরেবাংলা নগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, আগারগাঁও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল। তালিকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয় জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতালকে।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী অগ্নিঝুঁকিতে থাকা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে—শমরিতা হাসপাতাল, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার-২, ক্রিসেন্ট গ্যাস্ট্রোলিভার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, ধানমন্ডি জেনারেল অ্যান্ড কিডনি হাসপাতাল, ধানমন্ডি কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বিএসওএইচ হাসপাতাল, প্যানোরমা হসপিটাল লিমিটেড, ধানমন্ডি মেডি এইড জেনারেল হাসপাতাল লি. ও মেরিস্টোপ বাংলাদেশ।
সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও সতর্ক করা হয়েছিল তখন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালই সংস্থাটির এ সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি। বাস্তবায়ন করেনি তাদের সুপারিশও।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ বণিক বার্তাকে বলেন, জনস্বার্থে আমরা ঢাকাসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করে ঝুঁকি নিরূপণ করি। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়। হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করার জন্য লিখিতভাবে অন্তত তিন দফা মন্ত্রণালয়েও সুপারিশ করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও হাসপাতালগুলোকে অগ্নিঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক ও সুপারিশ করা হয়েছিল কিনা, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি অনু বিভাগ) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ফায়ার সার্ভিসের জরিপের ফলাফলে ঝুঁকিপূর্ণ, অতিঝুঁকিপূর্ণসহ কয়েকটি ভাগ ছিল। তার আলোকে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে বিষয়টি জানিয়েছি। তবে সেসব মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই।
ফায়ার সার্ভিসের তালিকা ধরে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতাল ও চারটি বেসরকারি হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ভবনের উচ্চতা ও স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা অনুপাতে কতগুলো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র প্রয়োজন, সে সম্পর্কে তাদের অধিকাংশেরই কোনো ধারণা নেই। যেসব অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে, সেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কেও জানেন না হাসপাতালের বেশির ভাগ স্টাফ। বিদ্যমান অবকাঠামো কতটা নিরাপদ, সে সম্পর্কেও তারা জানেন সামান্যই। এছাড়া যেসব জায়গায় অতিরিক্ত লোকসমাগম হয়, সেখানে স্মোক/হিট ডিটেক্টর লাগানোর যে শর্ত আছে, সেগুলোও মানা হয় না।
সরেজমিন অনুসন্ধানে প্রথমে যাওয়া হয় সিদ্ধেশ্বরীর মনোয়ারা হাসপাতালে। সাততলা হাসপাতালটির নিচতলায় ছয়টি ডিস্টিংগুইশার দেখা গেলেও দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় একটি করে ডিস্টিংগুইশার দেখা যায়। আর ষষ্ঠতলায় একটি ডিস্টিংগুইশারও চোখে পড়েনি। হাসপাতালটিতে হিট ডিটেক্টর বা ফায়ার অ্যালার্মও দেখা যায়নি।
মনোয়ারা হাসপাতালের পর পরিদর্শন করা হয় বেসরকারি স্কয়ার হাসপাতাল। সেখানে প্রতি তলায় মাত্র একটি করে ডিস্টিংগুইশার নজরে আসে। তবে এ হাসপাতালটিতে পর্যাপ্ত ফায়ার অ্যালার্ম রয়েছে।
স্কয়ারের পাশেই বিআরবি হাসপাতাল। এ হাসপাতালটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় চারটি এবং তৃতীয় তলায় ১০টি ডিস্টিংগুইশার চোখে পড়ে। কিন্তু পুরো হাসপাতালে কোথাও হিট ডিটেক্টর বা ফায়ার অ্যালার্ম দেখা যায়নি। ধানমন্ডি আই হসপিটালের অবস্থাও প্রায় একই রকম। হাসপাতালটিতে নামকাওয়াস্তে প্রতি তলায় একটি করে ডিস্টিংগুইশার থাকলেও ফায়ার অ্যালার্ম বা হিট ডিটেক্টর চোখে পড়েনি।
তবে অগ্নিনিরাপত্তায় বেসরকারি হাসপাতালের চেয়েও করুণ অবস্থা দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের। হাসপাতালটির পুরনো ভবনের নিচতলায় রয়েছে একটি মাত্র ডিস্টিংগুইশার। এছাড়া অন্য কোনো তলায় ডিস্টিংগুইশার নেই। আর ফায়ার অ্যালার্ম বা হিট ডিটেক্টরও চোখে পড়েনি সেখানে।
একই অবস্থা হাসপাতালটির বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটেও। সেখানেও নিচতলায় একটি মাত্র ডিস্টিংগুইশার রয়েছে। এছাড়া ওপরের কোনো তলাতেই ডিস্টিংগুইশার নেই। ফায়ার অ্যালার্ম বা হিট ডিটেক্টরও দেখা যায়নি কোনো তলায়। নবনির্মিত ঢামেক-২ ভবনেও ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালগুলোর তালিকা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে কিনা, তা জানতে যোগাযোগ করা হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। এ সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব (স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ) মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, তালিকা ধরে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা, সেটা ফাইল দেখে নিশ্চিত করা যাবে। তবে ব্যবস্থা নেয়া না হয়ে থাকলেও এখন অবশ্যই নেয়া হবে।
এদিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পর দেশের হাসপাতালগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুনের ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। আমাদের বেশকিছু হাসপাতাল আছে পুরনো, এগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। আমরা সব হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখব। এছাড়া হাসপাতালগুলোর বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও তার ঠিক আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন