দেশে জরায়ুমুখে ক্যানসারের রোগী বেড়েই চলছে। প্রতিবছরই আক্রান্ত হচ্ছেন ২৪ হাজার নারী। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। আর সে লক্ষ্যে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় শনিবার ‘জরায়ুমুখের ক্যানসার সচেতনতা’ দিবস পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রদিপাদ্য, ‘বাল্যবিবাহকে জোর না’।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাল্যবিয়ের কারণে বাংলাদেশে নারীদের জরায়ুমুখে ক্যানসার হয়ে থাকে। এ ছাড়া হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি), কম বয়সে ঘন ঘন সন্তান প্রসব, বহুগামিতা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ির ব্যবহারও এ রোগের সম্ভাবনা তৈরি করে। বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ নারী ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তাদের ২০ ভাগই আক্রান্ত হন জরায়ুমুখে। এ ছাড়া ক্যানসার নিয়ে অহেতুক ভয়, সামাজিক কুসংস্কার, পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব, অনেক ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের সুবিধা না থাকায় এটি দেরিতে ধরা পড়ে। ফলে আক্রান্তদের মধ্যে বছরে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি নারী মারা যান।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) তথ্যানুযায়ী, সারাবিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ ২৮ হাজার নারী জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে মারা যান ২ লাখ ৬৬ হাজার জন। বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ১১ হাজার ৯৫৬। বছরে মারা যান ৬ হাজার ৫৮২ জন। অর্থাৎ জরায়ুমুখের ক্যানসারে নারীমৃত্যুর হারে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোল্লাহ ওবায়েদুল্লাহ বাকী জানান, মহিলাদের ইউটেরাসের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জরায়ুর মুখে ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে নারীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণও এটি। সারাবিশ্বে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যে পরিমাণ লোক মারা যায়, তার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে নারীদের জরায়ু ক্যানসার। তবে বাংলাদেশে এটি প্রথম অবস্থানে। দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২০ হাজার নারী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এর মধ্যে ২০ শতাংশ অর্থাৎ ২৪ হাজার আক্রান্ত হন জরায়ু ক্যানসারে। আর এতে বছরে মারা যান সাড়ে ৬ হাজারের বেশি।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, ‘যৌনমিলনের সময় এইচপিভির মাধ্যমে জরায়ুমুখ আক্রান্ত হয়। নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতায় ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে এ ভাইরাস ধ্বংস হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১ থেকে ২ শতাংশ নারীর শরীরেই তা থেকে যায়। এর একটি অংশ পরবর্তীতে ক্যানসার হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, ঘন ঘন সন্তান ধারণ বন্ধ, এইচপিভি ভ্যাক্সিনসহ কিছু ভালো অভ্যাস গ্রহণ করলেই জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব। এ ছাড়া স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্ক্রিনিং অর্থাৎ ভিআইএ পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগের পূর্বাবস্থা শনাক্ত করতে হবে। এটি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা গেলে আক্রান্ত নারীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেশে নারীদের অসুখ হলে তা নিয়ে চলে লুকোচুরি। নারীরা তার শরীরিক সমস্যার কথা কাউকে জানতে চান না। সেটি জটিল হলেই পরিবারের লোকজন বুঝতে পারে। আর তখন বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যায়। আবার লজ্জা আর সংকোচের কারণে চিকিৎসককেও রোগের বিষয়ে পুরোপুরি জানানো হয় না। ফলে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। একপর্যায়ে রোগটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার পরই তার বিস্তারিত উঠে আসে। ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।
জরায়ু ক্যানসারের লক্ষণ : অতিরিক্ত অথবা অনিয়মিত রক্তস্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, অতিরিক্ত সাদা স্রাব, মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় রক্তপাত, তলপেটে ও কোমরে ব্যথা, সহবাসের সময় রক্তপাত। আর এসব লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসায় নিরাময় সম্ভব। এ জন্য অবশ্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন