ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচ্ছন্ন আস্কারায় গত চৌদ্দ বছরে বাংলাদেশে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা জঙ্গি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা করে নি। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, দখল থেকে শুরু করে খুনখারাবি, নারী ধর্ষণ কোনো কিছুই বাদ রাখেনি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে এলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা নানান হয়রানির ভয়ে চুপ থাকেন।
সম্প্রতি, চাঁদা চাওয়ার পর এক পানি ব্যবসায়ীকে নিজের টর্চার কক্ষে ডাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হাসান ওরফে সোহাগ। কিন্তু, সেই ব্যবসায়ী প্রাণনাশের আশঙ্কায় জঙ্গি ছাত্রলীগের এই নেতার ডাকে সাড়া না দেওয়ায় প্রথমে ফোনে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। এরপর ক্যাডার বাহিনী পাঠিয়ে সেই ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা।
ভুক্তভোগী পানি ব্যবসায়ী নিজেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি রাজধানীর বঙ্গবাজারের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা ও সরকারের মদদে পুলিশি হয়রানির আতঙ্কে নিজের পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ভুক্তভোগী সেই ব্যবসায়ী বলেন, গত ৩০শে জানুয়ারি ফোন করে চাঁদার জন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ডাকেন ছাত্রলীগ নেতা ইমদাদুল। যেতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে হুমকি-ধমকি দেন ইমদাদুল। পরে ৩১শে জানুয়ারী অনুসারীদের পাঠিয়ে পানির বোতল ভাঙচুর করিয়েছেন তিনি।
সেই পানি ব্যবসায়ীকে টেলিফোনে হুমকি-ধামকির কথোপকথনের অডিও সংরক্ষণ করে রেখেছেন ভুক্তভোগী সেই পানি ব্যবসায়ী।
ওই হুমকির অডিওতে ছাত্রলীগ নেতা ব্যবসায়ীকে বলেন, আনন্দবাজারে ব্যবসা করে আপনি কত বড় কুতুব হইছেন; আমি একটু আপনারে দেখব, ভাই। আপনার শখ হলে আপনি আনন্দবাজারে আসেন। আপনি কেমন মানুষ, একটু দেখব।
গত ৩০শে জানুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা ইমদাদুল হাসানের সঙ্গে ওই ব্যবসায়ীর কথোপকথনের রেকর্ডে ছাত্রলীগ নেতা ইমদাদুলকে বলতে শোনা যায়, আপনি কোথায়, ভাই? আপনাকে তো আমি খুঁজছি।
তখন ওই ব্যবসায়ী কারণ জানতে চান। জবাবে ইমদাদুল বলেন, আপনাকে একটু দেখব, ভাই। আপনাকে একটু দেখার শখ হইছে আমার।
ওই ব্যবসায়ী তখন ইমদাদুলকে গুলিস্তানে যেতে অনুরোধ করেন। এর জবাবে তিনি ওই ব্যবসায়ীকে বলেন, আমার এখন গুলিস্তান গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে হবে? আমার অত দরকার নেই, আপনার দরকার হইলে আপনিই আমার কাছে আসবেন।
কথোপকথনের একপর্যায়ে ওই ব্যবসায়ী অনুনয়-বিনয় করতে থাকলে ইমদাদুল তাঁকে অকথ্যভাষায় গালাগালি করে বলেন, ‘ওই (অপ্রকাশযোগ্য গালাগালি) ভাই, তুই এত কথা কস ক্যা? তুই আসলে আসবি, না আসলে থাকবি।
ওই ব্যবসায়ী তখন বলেন, ‘কী জন্য দেখা করব, ভাই? আপনার সঙ্গে তো আমার কোনো লেনদেন নাই। আপনারা থাকেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আর আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই। জবাবে ইমদাদুল বলেন, তোরে কি ফোনে বলতে হবে, কী দরকার? ঠিক আছে ফোন দিস না। পোলাপান পাঠাইছি, ওরা যা করার করবেনে। ব্যবসায়ী জানতে চান, পোলাপাইন দিয়ে কি মারবেন। তখন ইমদাদুল বলেন, তোর কলিজায় কী পরিমাণ বল যে তুই আমার সঙ্গে তর্ক করতেছিস! তোর কলিজায় এত বল কোত্থেকে আসে? তুই সামনাসামনি আয়। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। ওই ব্যবসায়ী তখন ইমদাদুলকে আবারও গুলিস্তানে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ঠিক আছে, মন চাইলে আমি গুলিস্তান যাবনে।
ইমদাদুলের আগে তাঁর এক ক্যাডার একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের এক নেতা ওই ব্যবসায়ীকে মোবাইল ফোনে কল করেন। তখন ওই ব্যবসায়ী বলেন, সে (ইমদাদুল) কী চায়? ওই নেতা উত্তর দেন, বোঝেন না আপনি, কী চায়? এটা কি বোঝানো লাগবে আপনারে? ওই ব্যবসায়ী বলেন, আমি তো ট্যাকাপয়সা দিমু না, ভাই। তখন ওই নেতা বলেন, তাঁকে দেবেন না, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার অন্য ছোট ভাইও তো আছে। আপনি তো ছোট ভাইরেও দেখতেছেন না। ছোট ভাইও তো পড়াল্যাহা করে। ওই ব্যবসায়ী তখন বলেন, আমি কাউরে ট্যাকা দিমু না, প্রয়োজনে ব্যবসা ছাইড়া দিমু।
ভুক্তভোগী ওই ব্যবসায়ী বলেন, নির্দেশ অনুযায়ী হলে গিয়ে দেখা না করায় ৩১শে জানুয়ারি রাতে পাঁচ-ছয়জন ক্যাডার পাঠিয়ে বঙ্গবাজারের গোল্ডেন প্লাজার সামনে রাখা পানির বোতল ভাঙচুর করান ইমদাদুল। সেখানে নেতৃত্ব দেওয়া একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের এক সহসভাপতি ও এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে তিনি চিনতে পেরেছেন।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, এ ঘটনায় তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ঘটনায় অভিযোগ পেলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন অমর একুশে হলের প্রাধ্যক্ষ ইসতিয়াক মঈন সৈয়দ।
এর আগে গত বছরের মার্চে একুশে হল-সংলগ্ন আনন্দবাজারের ব্যবসায়ী নেতাদের ডেকে নিয়ে এককালীন ১০ লাখ ও প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এনায়েত এইচ মনন ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হাসান। চাঁদা দিতে তাঁরা ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধমকির পাশাপাশি প্রাণনাশের হুমকিও দেন। চাঁদা না দেওয়ায় তখন বাজারের সাতটি দোকান বন্ধ করে দেন এনায়েত ও ইমদাদুল। ১০ দিনের বেশি সময় দোকানগুলো বন্ধ ছিল।
আনন্দবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বণিক সমিতির পক্ষ থেকে অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতাকে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। কিন্তু এতেও তাঁরা সন্তুষ্ট নন। আরও চাঁদার জন্য বিভিন্ন সময়ে হলে ডেকে নিয়ে ব্যবসায়ীদের মারধর ও অপদস্থ করেছেন তাঁরা। চাঁদা না দিলে প্রায়ই দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেতাদের অনেকে বাজারের খাবারের দোকানে খেয়ে পুরো টাকা দেন না, কেউ কেউ টাকাই দেন না। খাবারের মূল্য চাইলে কেউ কেউ দোকানের কর্মী ও ব্যবসায়ীদের ওপর চড়াও হন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন