নির্বাচন পর্যন্ত শক্তি ক্ষয় না করার কৌশলে জামায়াত
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েও হঠাৎ করেই পিছু হটেছে জামায়াতে ইসলামী। কৌশলগত কারণে তারা পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত শক্তি ক্ষয় করতে চায় না। মতাদর্শগত দিক থেকে বিএনপি অনেক কাছের হলেও দলটির প্রতি জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অভিমানও আছে। প্রয়োজনের সময় আন্দোলন-বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বিএনপির কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় এই অভিমান তৈরি হয়েছে। তাই পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সংগঠন শক্তিশালী করা এবং তাদের বাছাই করা নির্বাচনী এলাকাগুলোতে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজকেই গুরুত্ব দিচ্ছে তারা।
জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের দলের সঙ্গে বিএনপির মানসিক দূরত্ব তৈরি হয় যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় থেকে। দলটির ছয়জন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হলেও বিএনপি একটি বিবৃতিও দেয়নি। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনে আপত্তি আসে তৃণমূল থেকে। গত নভেম্বর মাসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। পরে ডা. শফিকুর জামায়াতের মজলিসে শূরার সদস্যদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করে এ বিষয়ে মতামত চান। জামায়াতের একজন শূরা সদস্য জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বিএনপি তাদের কাছে কম ক্ষতিকর এবং মতাদর্শগত দিক থেকে কাছের, এই বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের পক্ষে মতামত আসে। জামায়াতের বিপদেও বিএনপি পাশে দাঁড়াবে বলে মির্জা ফখরুল ও জামায়াত আমিরের বৈঠকে কথা হয় বলে তিনি জানান।
গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সভা থেকে সরকার পতনের আন্দোলনের লক্ষ্যে ১০ দফা ঘোষণা করা হয়। ওই ঘোষণার আধাঘণ্টার মধ্যে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুরও ১০ দফা পেশ করেন এবং যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। ৩০ ডিসেম্বর বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। জামায়াত অবস্থান নেয় মৌচাক এলাকায়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাদের প্রায় ৫০ জন কর্মী আহত হন এবং ১০ জন গ্রেপ্তার হন। ওই হামলার প্রতিবাদে এলডিপিসহ কয়েকটি সংগঠন বিবৃতি দিলেও বিএনপি কোনো বক্তব্য দেয়নি। জামায়াত নেতারা বলেছেন, বিএনপি নেতাদের একটি বিবৃতি দেওয়ার জন্য বলা হলেও তাঁরা দেননি।
সূত্র জানায়, ২ জানুয়ারি জামায়াতের মজলিসে শূরার এক ভার্চুয়াল বৈঠকে আলোচনা হয়, আপাতত তারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করবে না। তার বদলে নির্বাচন পর্যন্ত সংগঠন শক্তিশালী করা এবং তাদের বাছাই করা নির্বাচনী এলাকাগুলোতে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ করবে। আন্দোলনে নামলেই জামায়াতের ওপর আরো কঠোরভাবে সরকার চড়াও হয়, গ্রেপ্তার ও হামলা-মামলার সংখ্যা বাড়ে, অন্যদিকে বিএনপিও তাদের পাশে দাঁড়ায় না। সে জন্য জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন থেকে সরে আসার কৌশল নিয়েছে। ১০ ও ১৬ জানুয়ারি বিএনপি দুটি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করলেও জামায়াত করেনি।
জামায়াতকে অবৈধ ঘোষণার দাবিতে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট তাদের অবৈধ ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর বিরুদ্ধে জামায়াতের পক্ষে আপিল করা হয়, আপিলটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
আইন অনুসারে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত না হলেও দল হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারবে, তবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। ২০১৮ সালে জামায়াত ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছে। আগামী দিনে নির্বাচনে জামায়াত ধানের শীষের পরিবর্তে অন্য কোনো প্রতীকে নির্বাচন করতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা।
১৯৪০ সালের ৭ আগস্ট আত্মপ্রকাশের পর এ পর্যন্ত জামায়াত তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছে। আবার নিজ নামে নিবন্ধনও ফিরে পেয়েছে। মাঝে অন্য নামেও সংগঠন করেছে। ১৯৭২-১৯৭৫ পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকার সময় জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সক্রিয় ছিল ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগের (আইডিএল) ব্যানারে। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে জামায়াতে ইসলামীকে সংগঠন করার সুযোগ দেন।
জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, এবার ভিন্ন নামে সংগঠনের নিবন্ধন নেওয়ার চিন্তাও রয়েছে নেতাদের মধ্যে। প্রথমে তাঁরা কল্যাণ পার্টিতে শামিল হওয়ার চিন্তা করেছিলেন, পরে সেই অবস্থান থেকে সরে এবি পার্টি করার সিদ্ধান্ত নেন। এখন পর্যন্ত ওই সিদ্ধান্ত থাকলেও নেতারা মনে করছেন, বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ায় এবি পার্টির নিবন্ধনেও ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিবন্ধন পাওয়া সমমনা অন্য কোনো দলও হতে পারে জামায়াতের ঠিকানা।
জামায়াতের প্রচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যুগপৎ আন্দোলনে আছি, তবে ৩০ ডিসেম্বরের পর দুটি কর্মসূচি আমরা যুগপৎ করিনি, এটা ঠিক। কেন করিনি সেই ব্যাখ্যা বিএনপির কাছে চাইলে ভালো হয়। বিএনপি ১০ ও ১৬ জানুয়ারি যে কর্মসূচি পালন করেছে সে বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করেনি, লিয়াজোঁ কমিটিতেও জামায়াতকে রাখা হয়নি। এখন বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি তো জামায়াত পালন করবে না।’ তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে নামলে জামায়াতে ইসলামীরই বেশি শক্তি ক্ষয় হয়। সরকার জামায়াতকে বেশি ভয় পায়। আমাদের রাজনীতির কৌশল তো আমরা নেবই, তবে যুগপৎ আন্দোলনে আমরা আছি, কারণ আমাদের আমির ১০ দফা ঘোষণা দিয়েছেন।’
জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা জোটবদ্ধ আন্দোলন করছি না, যুগপৎ আন্দোলন করছি। তবে দেখছি, জামায়াত কখনো যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে আবার কখনো নিচ্ছে না। এখন কেন তারা এমন করছে, এটা তারাই ভালো জানে। হয়তো তাদের কোনো কৌশল আছে।’
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত হচ্ছে তুরুপের তাস। তাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করে এক উদ্দেশ্যে, বিএনপি করে আরেক উদ্দেশ্যে। প্রকৃতপক্ষে কেউ চায় না যে জামায়াত নিষিদ্ধ হোক। স্বাধীনতার পর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তবে সেটা বাহাত্তর সালের সংবিধানে রাখা উচিত ছিল। তা করা হয়নি বলে পঁচাত্তরের পর তাদের সহজে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়। এখন জামায়াত কৌশল হিসেবে ভিন্ন নামে রাজনীতি করতে পারে, দলও করতে পারে। তবে সেটা করলেও জামায়াতের মতোই তারা আলোচিত থাকবে, কারণ লোকগুলো তো একই। এখন জামায়াত যদি বোঝে, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের চেয়ে ভিন্ন নামে দল করলে তারা সরকারের অনুগ্রহ পাবে বা তাদের ওপর নির্যাতন কম হবে, তাহলে তারা সেটাই করবে। তবে বলা যায়, বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বরং আওয়ামী লীগকে রাজনীতির কিছু বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন