রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক বেআইনি, মিথ্যা ও গায়েবি মামলা বন্ধ এবং দায়েরকৃত হয়রানিমূলক সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) চিঠি দিয়েছে বিএনপি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে দেখা করে বিএনপির প্রতিনিধি দল মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত এ চিঠি দেয়।
একই সঙ্গে প্রতিনিধি দলে থাকা নেতারা বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মিথ্যা মামলার ভিত্তিতে গ্রেফতারসহ ঢাকার গণসমাবেশের স্থান নিয়েও কথা বলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, গায়েবি মামলা হয়ে থাকলে তা খতিয়ে দেখবেন বলে বিএনপি নেতাদের আশ্বাস দেন আইজিপি।
এ সময় ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ করার অনুমতি দিতে পুলিশপ্রধানকে অনুরোধ জানানো হয়।
তবে এ নিয়ে তিনি কোনো ইতিবাচক আশ্বাস দেননি। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি আইজিপি বিএনপি নেতাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই গণসমাবেশ করতে অনুরোধ জানান।
বৈঠকের আলোচনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেখানে উপস্থিত বিএনপি প্রতিনিধি দলের এক নেতা যুগান্তরকে জানান, ‘ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা বিভাগীয় গণসমাবেশের উদাহরণ টেনে আমরা বলেছি, সব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। কোথাও বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়নি। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে, ক্ষমতাসীন দল নানাভাবে বাধা দিয়ে গণসমাবেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টা করেছে। কিন্তু আমরা সে পথে হাঁটিনি। চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। এছাড়া নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বহু সমাবেশ হয়ে আসছে। সেখানেও আজ পর্যন্ত কোনো বিশৃঙ্খলা দলের পক্ষ থেকে হয়নি। পুলিশও তা বলতে পারবে না। তাহলে কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে নয়াপল্টনে গণসমাবেশ করতে বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা কথা দিচ্ছি, নয়াপল্টনে কোনো বিশৃঙ্খলা হবে না। সুশৃঙ্খলভাবে সমাবেশ করতে বিএনপির শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করবে। এজন্য বিএনপি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা চায়।’
বেলা ১টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলুর নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে বৈঠকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে বরকতউল্লা বুলু সাংবাদিকদের বলেন, ‘সারা দেশে গায়েবি মামলা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগের লোকজন বোমা ফাটিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে, গ্রেফতার করছে। এর তথ্যসহ একটি চিঠি মহাসচিবের পক্ষ থেকে আমরা আইজিপিকে দিয়েছি। উনি (আইজিপি) আমাদের প্রতিনিধি দলের সবার বক্তব্য শুনেছেন। বিভিন্ন জায়গায় গায়েবি মামলা দায়ের করাসহ নেতাকর্মীদের হয়রানি, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও গ্রেফতার অব্যাহত আছে। আমরা এই অন্যায়ের প্রতিকার চেয়েছি। আইজিপি এগুলো খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন।’
‘গায়েবি’ মামলার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বুধবারও হাইকোর্ট থেকে বিভিন্ন জায়গার সাড়ে চারশ নেতাকর্মী জামিন নেওয়ার পর হাইকোর্টের গেট থেকে ৫০ জনকে তাদের ল’ইয়ার্স সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলে গ্রেফতার করেছে। নরসিংদীতে একটা গায়েবি মামলা দিয়েছে। সেই মামলায় উল্লেখ আছে-চলো চলো, ঢাকায় চলো, খালেদা জিয়া জিন্দাবাদ, তারেক রহমান জিন্দাবাদ বলে ৫-৬টি ককটেল ফাটিয়েছে। এজন্য এই মামলা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবিতে ঢাকায় গণসমাবেশে আসার জন্য বিএনপির নেতাকর্মীরা মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু এজন্য ককটেল ফাটাবে কেন? এটা তো হাস্যকর তথ্য। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এটা করতে পারে না।’
ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশে স্থান নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বুলু বলেন, ‘আমরা বলেছি নয়াপল্টনে করতে চাই। সমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে ইতোমধ্যে ডিএমপি কমিশনারকে দুটি চিঠি দিয়েছি। চিঠিতে নয়াপল্টনের কথায় বলা হয়েছে। অন্য কোনো স্থান চায়নি। কিন্তু উনারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করতে বলেছেন।’
চিঠিতে যা আছে : বিএনপি মহাসচিব স্বাক্ষরিত আইজিপিকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি পুলিশ কর্তৃক রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মিথ্যা মামলা দায়ের এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন চরমতম পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ একটি পত্রিকার প্রতিবেদন তুলে ধরে বলা হয়, ‘ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিস্তারিত তথ্যসহ তালিকা প্রস্তুত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।’
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘সারা দেশের জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতাকর্মীদের তালিকা প্রস্তুত করছে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ। কতিপয় অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তার বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য গোটা পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, যা প্রত্যাশিত নয়।’
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত আগস্ট থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় গায়েবি ও মিথ্যা মামলা হয়েছে ১৬৯টি। সেখানে নাম ধরে আসামি করা হয়েছে ৬ হাজার ৭২৩ জনকে। বেনামে আসামি করা হয়েছে ১৫ হাজার ৫০ জনকে।
কয়েকটি পত্রিকায় গায়েবি মামলাসংক্রান্ত প্রতিবেদন তুলে ধরে বলা হয়, ‘এসব খবরের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, চলতি মাসেই পুলিশ বাহিনী যে গায়েবি মামলা করেছে, সেসব মামলার সব আসামি বিএনপির নেতাকর্মী। একই ঘটনায় দুই থানায় পৃথক মামলা হয়েছে, বাদী নিজেই জানেন না আসামির সংখ্যা কত। সাক্ষীও বিস্ফোরণের শব্দ শোনেননি এবং ঘটনাস্থলের বাসিন্দারা কিছুই জানেন না। মামলার বাদী পুলিশ কিংবা আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং অধিকাংশ মামলার অভিযোগ হুবহু এক।’
চিঠির এক স্থানে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পুলিশ আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে। এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, পুলিশ বাহিনীর অতিউৎসাহী কতিপয় কর্মকর্তা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার এবং নাগরিকের ন্যায়বিচারের অধিকারকে শুধু ক্ষুণ্নই করেনি, কখনো কখনো কতিপয় পুলিশের কিছু কর্মকাণ্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতীয়মান হয়।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন