বহু আলোচিত সমালোচিত জান্নাত আরা হেনরী। বর্তমানে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সংগঠনের নেত্রীদের অভিযোগ, এক সময় হাইস্কুলের শিক্ষক হেনরী রাজনীতিতে এসে গত ১৩ বছরে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। সাদামাটা জীবনকে করেছেন রঙিন।
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে স্বল্প বেতনে স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি টেলিভিশনে গান গাইতেন জান্নাত আরা হেনরী। এসব বাদ দিয়ে রাজনীতিতে আসার পরই বদলে যেতে থাকে তার জীবন। পাল্টাতে থাকে তার জীবনযাপনের ধরনও।
দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকলেও অদৃশ্য কোন জাদুবলে শত কোটি টাকার মালিক হেনরী? এত অল্প সময়ে শত কোটি টাকার মালিক হলেন কীভাবে? এসব প্রশ্ন তুলছেন খোদ মহিলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই।
এক নেত্রীর অভিযোগ, ২০০৯ সালে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হন হেনরী। এরপরই পাল্টে যায় তার জীবন। মালিক হন বিপুল অর্থ-বিত্তের। গাড়ি-বাড়ি আর সামাজিক অবস্থানেরও হয় রাতারাতি পরিবর্তন।
হেনরীর এ উত্থান সিরাজগঞ্জবাসীকে ফেলে দেয় এক ঘোরের মধ্যে। এখন সেই অবৈধ টাকার জোরে দলীয় পদ ভাগিয়ে নিতে বিভিন্ন নেতার দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরী।
সম্মেলনকে সামনে রেখে টাকার বিনিময় লোক ভাড়া করে এনে ধানমন্ডি সভানেত্রীর কার্যালয়ে নিজের নামে স্লোগান ও শোডাউন করান তিনি। এমনকি মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন করতে প্রায় লাখ টাকা ডোনেট করে সাধারণ সম্পাদক মাহমুদার সঙ্গে সখ্যাতা করে চলছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত মোতাহার হোসেন তালুকদারের পুত্রবধূ হিসেবে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ (সদর) আসন থেকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান হেনরী। কিন্তু জনপ্রিয়তা না থাকায় বিএনপির প্রার্থী রুমানা মাহমুদের কাছে পরাজিত হন।
এছাড়া জান্নাত আরা হেনরীর বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করেছন। সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ঋণপ্রদান, চাকরি বাণিজ্য, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও বদলি, ঋণ মওকুফ, শাখা খোলাসহ বিভিন্ন তদবির-বাণিজ্য করতেন হেনরী। এসব কাজে তিনি এক পার্সেন্ট কমিশন নিতেন। এসব করে মাত্র কয়েক বছরে হেনরী প্রায় ১২০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এক যুগের ব্যবধানে স্কুল শিক্ষিকা থেকে বগুড়া অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ করদাতা হয়েছেন হেনরী। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারীতেও অভিযুক্ত ছিলেন তিনি।
সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হওয়ায় পরে হেনরী এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে ব্যক্তি মালিকানায় জমিসহ বিভিন্ন সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে দখল করেন এবং জোর করে জমি লিখে নেন। এছাড়াও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে গোপনে নিজ নামে জমি খারিজ করে নেন।
এ বিষয়ে মো. আব্দুস ছালাম খান নামে একজন ভুক্তভোগী সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ভূমি অফিসার বরাবর অভিযোগ করেছেন (মিসকেস নং-১০৪/ওঢ-ও/২০১৯-২০২০)। এই অভিযোগ তদন্ত করে মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নামজারি করায় জান্নাত আরা হেনরীর নামে হওয়া উক্ত নামজারি বাতিল করেন উপজেলা ভূমি অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
এছাড়া তার নামে টেন্ডারবাজির অভিযোগ আছে। হেনরীর স্বামী লাবুর ঠিকাদারি লাইসেন্স থাকলেও তিনি বর্তমানে ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন না। চায়না একটি কোম্পানির নামমাত্র উপদেষ্টা তিনি। হেনরীর স্বামী লাবু এবং মেয়ে মুনতাহা হৃদয়ীর অ্যাকাউন্টেও বিপুল পরিমাণ টাকা আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১২ সালে হেনরীর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, স্বামী শামীম তালুকদার লাবু, মেয়ে মুনতাহা হৃদয়ীর নামে ছয়টি ব্যাংক শাখায় কোনো প্রকার হিসাব পরিচালিত হয়ে থাকলে তা দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয় পাবনা বরাবর পাঠানোর জন্য বলা হয়েছিল।
সংগঠনের নাম ব্যবহার করে সচিবালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের তদবিরে বাণিজ্য করার অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হেনরীর বিরুদ্ধে।
মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম ঢাকা টাইমসে বলেন, ‘হলমার্ক কেলেঙ্কারির যে ঘটনা ঘটেছে, সেখানে শুধু জান্নাত আরা হেনরীর নাম ছিল না, আরও ১১ জনের নাম ছিল। সবাই মামলা থেকে খারিজ হয়ে গেছে। এছাড়া তার নামে যদি জমি দখল, টেন্ডারবাজি, তদবির বাণিজ্যে, অর্থ আত্নাসাৎ করার অভিযোগ থাকে সেটা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সম্মেলন উপলক্ষে নেতাকর্মীদের কাছে টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে হেনরীর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদা বেগম বলেন, ‘সম্মেলন করতে তো টাকা লাগবে। নেতাকর্মীরা টাকা না দিলে টাকা পাব কোথায়? আমরা কি বাইরে থেকে গিয়ে চাঁদাবাজি করবো?’ আওয়ামী লীগের পক্ষেও তো টাকা দেওয়া হয়েছে, এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘না, সম্মেলন করতে দলের পক্ষ থেকে টাকা দেওয়া হয়নি।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জান্নাত আরা হেনরী ঢাকা টাইমসে বলেন, ‘আমার নামে দুদকে অভিযোগ ছিল। কিন্তু দুদক তদন্ত করে কিছুই পায়নি। আমার নামে মামলাও হয়নি। আমি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্য থাকাকালে কমিশনের বিনিময়ে ঋণ দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা।’
তিনি বলেন, ‘আমি দুর্নীতি করলে তো প্রধানমন্ত্রী আমাকেও শাস্তি দিতেন। তাছাড়া আমার বিরুদ্ধে কে কী অভিযোগ করলো তা নিয়ে ভাবি না।’
মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে তদবিরের অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে হেনরী বলেন, ‘আমি যেহেতু সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী, সেক্ষেত্রে নেতাদের কাছে আমি যাবোই, আমি যেতে পারি না? কিন্তু কেউ যদি বলে আমি টাকা দিয়ে পদ কেনার চেষ্টা করছি, সেটা মিথ্যা।’
কালো টাকা সাদার করার বিষয়ে জানতে চাইলে হেনরী বলেন, ‘এসব মিথ্যা ও বানোয়াট।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার শ^শুর চাইতেন না আমরা অন্য কোথাও চাকরি করি। তাই নিজেদের স্কুলে চাকরি করতাম। আমি রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক হইনি। ২০০৮ সাল থেকে ২০২২ সাল দেড় যুগ অনেক সময়।’
শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার পেছনে আয়ের উৎস কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার আয়ের উৎস জানতে হলে এনবিআরের কাছে চান। আমার এক টাকাও অবৈধ নয়। আমার কোনো অবৈধ সম্পদও নেই।’
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন