গণতন্ত্রের ওপর বেশকিছু সূচক বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘আধা-স্বৈরাচারী’, ‘হাইব্রিড’ বা শুধুমাত্র ‘আংশিক মুক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে ২০০০-এর শেষের দিকে পুনঃগণতন্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দেখানো সত্ত্বেও, দেশটি ‘গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ’-এর পথে ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-যেটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-দেশে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণকে ত্বরান্বিত করেছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইসলামপন্থি দলগুলির মধ্যে (বাম/ডান বিভাজন প্রতিফলিত করে) ফাটল বাড়িয়েছে এবং দুটি বিরোধী গণআন্দোলনের দিকে পরিচালিত করেছে। ট্রাইব্যুনালের সফল সমাপ্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধে ট্রাইব্যুনালপন্থি, বামপন্থি শক্তিরা জয়ী হয়। কিছু বিশেষজ্ঞ দাবি করেন যে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, এটি এমন নীতি প্রণয়ন করেছে যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু অধিকার এবং নারীর ক্ষমতায়ণকে ক্ষুণ্ন করে, গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ এবং দেশকে সামগ্রিকভাবে ডানপন্থি হিসেবে পরিবর্তনে অবদান রাখে। অন্য একপক্ষ যুক্তি দেয় যে দলের নীতিগুলি বিরোধীদের আরও প্রান্তিককরণে অবদান রেখেছে। আজ বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো সংগ্রাম করছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০১৪ সালের নির্বাচনী বয়কট থেকে পুরোপুরি নিজেদের পুনরুদ্ধার করতে পারেনি এবং এ দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে কারাবরণ করেছিলেন। ২০২০ সালে সরকারি আদেশের মাধ্যমে তাকে কিছু শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। পরে এর মেয়াদ বাড়ানো হয় কয়েক দফায়। বিএনপি নেতৃত্ব এখনো দমন-পীড়নের অভিযোগ করে।
অন্য একটি ডানপন্থি দল জাতীয় পার্টি (জাপা), প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তার ভূমিকা বজায় রাখতে লড়াই করছে, যদিও ৩৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে মাত্র ২৬টি আসন রয়েছে তাদের হাতে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের কারণে চরম ডানপন্থি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের নিবন্ধন হারায়। আরেকটি অতি-ডানপন্থি দল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (ওঅই), ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের দিক থেকে ভালো করলেও এটি সংসদে একটি আসনও পেতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ডানপন্থি দলগুলোর থেকে এখনই কোনো নির্বাচনী হুমকি নেই, বিশেষ করে কিছু বামপন্থি দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনই কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম।
একটি বিষয় পর্যবেক্ষকদের অবাক করে যে, কেন বামপন্থী দলগুলি তাদের প্রভাব প্রয়োগ করতে এবং দেশে ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদকে উল্টাতে ব্যর্থ হয়েছে। আজকের বাংলাদেশে, এই দলগুলির অবস্থাকে এক বিশেষজ্ঞ ‘অণুবীক্ষণিক অবস্থা’ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলির প্রাতিষ্ঠানিক এবং আদর্শগত কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা তাদের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষমতা হ্রাস করে। এই নিবন্ধটি লেখার সময় বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা এবং চারটি বামপন্থি দলের প্ল্যাটফরম, ইশতেহার এবং প্রকাশনার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নিবন্ধটি বামদের মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জগুলিকে চিহ্নিত করে যা বামপন্থিদের ‘অভিজাত’ এবং ‘নাস্তিক’ হওয়ার খ্যাতি, নাগরিক সমাজের নেটওয়ার্কগুলিতে জড়িত থাকতে তাদের অক্ষমতা, এবং আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আজ প্রশ্ন উঠে গেছে।
বাংলাদেশে বামপন্থি দলগুলোর ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশের বামপন্থি দলগুলোর বৃটিশদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুনিপুণ ইতিহাস রয়েছে। দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে, বাংলাদেশি বামপন্থিরা পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। এসব দলের প্রকাশ্যে কাজ করার অনুমতি না থাকলেও কিছু দল আওয়ামী লীগের মাধ্যমে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার পর, বামপন্থি দলগুলো অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে দ্বন্দ্বের শিকার হয়। এমনকি ১৯৭২ সালে যখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তখনো বামপন্থি দলগুলি বিরোধী রাজনীতির জন্য একমাত্র কার্যকর বিকল্প হয়ে উঠেছিল, তখনো এই দলগুলি কীভাবে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু করা যায় সে বিষয়ে একমত হতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থান আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়, কিন্তু বিরোধী রাজনীতি তখনো সীমাবদ্ধ ছিল। ১৫ বছরের সামরিক স্বৈরাচারের পর, দুটি কেন্দ্রবাদী দল ছোট বামপন্থি দলগুলির সঙ্গে জাতিকে সংঘবদ্ধ করে এবং ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তারপরও বামপন্থি দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে লড়াই করছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মতো সুপরিচিত দলগুলোর কিছু সংসদীয় প্রতিনিধিত্ব রয়েছে, তবে তাদের নির্বাচনী এলাকা এবং ভোটের সংখ্যা খুবই কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচালিত ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) ইঙ্গিত দেয় যে এই দলগুলি এতটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে যে বেশিরভাগ তরুণ ভোটাররা দুটির বেশি বামপন্থি দল বা তাদের নেতাদের নামও বলতে পারে না। অংশগ্রহণকারীরা স্বীকার করেছেন যে এই দলগুলির রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে তাদের খুব একটা ধারণা নেই। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের মন্তব্য ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলোর বৈধতা আজ সংকটের মুখে। শেষ পর্যন্ত, এই সংকট স্বৈরাচারী শাসন এবং বামেদের এজেন্ডা জনপ্রিয় করতে ব্যর্থতার ফলে উদ্ভুত হয়েছে।
বড় দলগুলোর মাধ্যমে রাজনীতি: দলীয় ক্ষমতার ক্ষয়
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশি বামপন্থি দলগুলির তাদের মধ্যপন্থি দলগুলোর তুলনায় স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের অভাব রয়েছে। বামপন্থি দলগুলি মূলধারার দলগুলির মাধ্যমে রাজনীতি করে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ক্রোধ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। স্বৈরাচারী শাসন এবং আইনি বাধা পেরোনোর লক্ষ্যে মূলধারার দলগুলির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত হবার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছিল-যেমন পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা এবং সামরিক একনায়কত্বের অবসান-কিন্তু এই কৌশলটির অর্থ হলো বামপন্থি দলগুলি তাদের মূলধারার সমকক্ষদের ছায়ায় বিদ্যমান। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের অবসানের পর, জোটের রাজনীতি এই নির্ভরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। একজন প্রবীণ বামপন্থি রাজনীতিবিদ ব্যাখ্যা করেছেন: ‘জোটের রাজনীতির কিছু সুবিধা ও লাভ আছে। এই সুবিধা এবং লাভ হারানোর ভয়ে, বামপন্থিরা কখনো কখনো নিপীড়ন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষেত্রে একটি নরম পন্থা অবলম্বন করে। এটাকে আমি সুবিধাবাদী প্রবণতা বলবো। এই সুবিধাবাদের কারণে, কখনো কখনো তারা মাঠে, সংসদের অভ্যন্তরে এবং বাইরে, রাজপথে প্রত্যাশামাফিক তেমন সক্রিয় হতে পারে না।
এটি বড় দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের একটি সমস্যা।’ এই ব্যাখ্যাগুলি প্রমাণ করে যে জোটে থাকা বামপন্থি দলগুলি প্রায়শই কেন্দ্রথাকা দলগুলিকে জবাবদিহি করতে এবং বিকল্প নীতি প্রস্তাবের জন্য চাপ দিতে কম সক্ষম। নেতৃস্থানীয় দলগুলিও, বামপন্থি নীতি প্রস্তাবগুলিকে বিবেচনায় না নিয়ে সুযোগ নেয়। তার ‘রাজনৈতিক কর্মসূচিতে’ জাসদ স্বীকার করেছে যে, আওয়ামী লীগের জোটগত অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয় না। দলের একটি অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে- ‘১৪ দলীয় জোট এবং অতীতে মহাজোটের শরীক হওয়া জাসদের আসন সংখ্যা নিয়ে খুশি নন জাসদের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। নির্বাচনী জোটের ফলে জাসদকে যে পরিমাণ আসন দেয়া হয়েছে তা দলের জন্য সম্মানজনক নয় বলে মনে করেন দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। আমরা অবশ্যই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই। যদিও বাস্তবটা নির্মম। আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে দলের প্রতি যত অবিচার করা হয়েছে তা দলের নিজেদের দুর্বলতার কারণেই হয়েছে। আমাদের নিজেদের দুর্বলতা আমাদের বাধ্য করেছে আসন বণ্টন নিয়ে এই সমঝোতা মেনে নিতে।’
‘সম্ভ্রান্তবাদী’ এবং ‘নাস্তিক’ হিসেবে পরিচিতি
ভারতীয় উপমহাদেশের বামপন্থি রাজনীতিবিদদের অভিজাত হিসেবে খ্যাতি রয়েছে। মার্কস্বাদ ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় ‘ভদ্রলোক’ নামে পরিচিত শিক্ষিত, তরুণ হিন্দুদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই আলোকিত গোষ্ঠী ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির নবজাগরণের জন্য দায়ী ছিল কিন্তু বাস্তব জগৎ সম্পর্কে তাদের অবুঝ এবং অজ্ঞাত বলেও মনে করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এই উপলব্ধি আরও গভীর হয় যখন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভয়ে অল্পসংখ্যক হিন্দু কমিউনিস্ট পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানে থাকতে চলে যায়। যারা পিছনে থেকে গিয়েছিলেন তারা বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন, বামপন্থিদের ‘পেটি-বুর্জোয়া বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এবং ছাত্রদের’ মধ্যে কমিউনিস্ট ধারণার প্রচারকে সীমিত করেছিলেন এবং তাদের অভিজাত খ্যাতি মজবুত করেছিলেন। আইনি বিধিনিষেধগুলি এই দলগুলিকে পাকিস্তানের সামরিক একনায়কত্বের অধীনে অবাধে কাজ করতে এবং নিজেদের প্ল্যাটফরম প্রসারিত করার সুযোগকে বাধা দিয়েছিল। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখনো বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের এভাবেই দেখে। বামপন্থি রাজনীতিবিদ এবং কর্মীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, ঋএউ উত্তরদাতারা তাদের ‘নাকউঁচু’ এবং ‘অভিজাত’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন অধ্যাপক আরামদায়ক শহুরে পরিবেশ থেকে বিপ্লবের কথা বলার প্রবণতাকে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বামপন্থিদের ব্যর্থতার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন। তার কথায়- ্তু‘বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মতো তারা আত্মত্যাগ করতে পারে না। তাদের প্রবণতা যথাসম্ভব স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ না করে ভালো করার। মানসিকতা এই রকম: ‘আমি আমার বিশ্বাসের সঙ্গে আপস করবো না, এদিকে আমি আত্মত্যাগও করবো না। অর্থাৎ আমি ঝুঁকি নেবো না। এখানে সমঝোতা বলতে বোঝায় কৌশলগত সমঝোতা। কিন্তু উচ্চবিত্তের মর্যাদা পেছনে ফেলে বাংলাদেশে তাদের পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই।’ দলগুলির এই কথিত অভিজাত মনোভাব বামপন্থি সংগঠনগুলির ছাত্র ফ্রন্টগুলিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তরুণ বামপন্থি কর্মীদের এই উপলব্ধি সম্ভবত একটি গভীর বিশ্বাস থেকে আসে যে সমস্ত লোক তাদের রাজনৈতিক বার্তা বোঝার জন্য সমানভাবে সক্ষম নয় এবং তাই তাদের প্রচেষ্টাগুলি সত্যই আগ্রহীদের দিকে মনোনিবেশ করে। তাই, এমনকি পাবলিক ইউনিভার্সিটি-এর মধ্যেও বামপন্থিরা তেমন সমর্থন জোগাড় করতে পারেনি।
একজন বামপন্থি রাজনীতিবিদ, তবে, এই স্টেরিওটাইপের বিরোধিতা করে দাবি করেছেন যে তার দলের কর্মীদের তরুণ প্রজন্ম এখনো গ্রামাঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে যেখানে তারা কৃষক এবং দরিদ্র লোকদের সংগঠিত করে। তবে একটি বিষয় ওই রাজনীতিবিদ স্বীকার করেছেন যে- ‘অহংকার’ বামপন্থি সুনামের ক্ষতি করেছে এবং বামপন্থি রাজনীতিবিদদের জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে বামপন্থিদেরও নাস্তিক বলে পরিচিতি রয়েছে। যার জেরে বামপন্থিদের পক্ষে তৃণমূল স্তরে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং একটি স্থিতিশীল নির্বাচনী এলাকা তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে, “আপনি যদি গ্রামাঞ্চলে যান এবং মানুষকে বলেন যে আপনি একজন নাস্তিক, তারা আপনার দিকে এমনভাবে তাকাবে যেন তারা একটি সাপ দেখেছে। বাঙালী মুসলমানরা নাস্তিক শব্দটি শুনে আতঙ্কিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে স্বৈরাচারী শাসকরা বামপন্থিদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় এই বলে যে তারা ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী। একজন প্রবীণ বামপন্থি রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেছিলেন যে ‘এই লেবেলটি (নাস্তিক) সরানো যাবে না। এটা আগেও ছিল, এখনো আছে এবং সবসময় থাকবে।’ ২০১৩ সালে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড এবং ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন শুরু হলে এই ধরনের মানহানি আরও জোরালো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থি ছাত্ররা ইসলাম বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতাকে উন্নীত করার জন্য ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনার মুখে পড়ে। ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল কাউকে চিহ্নিত করার জন্য ‘নাস্তিক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল, যদিও এর সঙ্গে জড়িত কয়েকজন কর্মী স্বঘোষিত নাস্তিক ছিলেন।
বামপন্থি রাজনীতিবিদদের উপর এই ধরনের আক্রমণ আজও অব্যাহত রয়েছে; বিখ্যাত ধর্মীয় প্রচারকরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের সহানুভূতির জন্য রাজনীতিবিদদের ‘নাস্তিক’ হিসাবে চিহ্নিত করেন। এই নেতাদের ‘ধর্মত্যাগী’, ‘নাস্তিক’ এবং ‘ইসলামের শত্রু’ বলা হয়। বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলি উপলব্ধি করে যে তাদের মতাদর্শের প্রতি টিকে থাকার এবং প্রচলিত ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে আঘাত করা এড়ানোর মধ্যে একটি ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে স্বচ্ছতা প্রদান এবং এটিকে বাংলাদেশমুখী করার পরিবর্তে, বেশিরভাগ বামপন্থি রাজনীতিবিদরা সেই কৌশলটি বেছে নিয়েছেন যা আওয়ামী লীগ ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ব্যবহার করে আসছে- ধার্মিকতা প্রদর্শন করে তাদের নেতারা ধর্ম বিরোধী অভিযোগগুলি এড়িয়ে চলেছে। ঋএউ’র প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী-মক্কায় পবিত্র তীর্থযাত্রা শুরু করা বা রাজনৈতিক বক্তৃতায় ইসলামিক নথির উল্লেখ করার মতো ধার্মিকতার প্রকাশ্য প্রদর্শনগুলি বামপন্থিদের এই ধারণাটি দূর করতে খুব বেশি সাহায্য করবে না যে তারা ধর্মবিরোধী। উল্টো এই ধারণার জন্ম দেবে যে বামপন্থীরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক পয়েন্ট স্কোর করার চেষ্টা করতে এই ধরনের কৌশল নিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন উত্তরদাতা মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা জাসদ এবং বাসদ- এর মতো বামপন্থি দলগুলিকে দেখেছি যারা প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সমাবেশে বামপন্থি শব্দ ভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে। তবে, তারা যখন প্রকৃত রাজনীতিতে, মানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তখন তারা ধর্মের কার্ডও খেলার চেষ্টা করে। আমরা দেখেছি যে হাসানুল হক ইনু থেকে রাশেদ খান মেনন পর্যন্ত বামপন্থি রাজনীতিবিদরা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ধর্মীয় বিষয়গুলি উপস্থাপন করেছেন, এমনকি তাদের পোস্টারে ধর্মীয় বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন। অন্য একজন উত্তরদাতা আরও ব্যাখ্যা করেছেন যে ‘তাদের মূল আদর্শ হতে পারে মার্কস্বাদ। কিন্তু তাদের মধ্যেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো সুবিধাবাদী প্রবণতা রয়েছে। যেহেতু ‘বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, তাই তারা ধর্মকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে।’
সাংগঠনিক সংযোগের অভাব
গত এক দশকে গ্রিস, পর্তুগাল এবং স্পেনের বামপন্থি দলগুলোর সাফল্য থেকে বোঝা যায়, সমমনা গোষ্ঠী এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র ছোট দলগুলোকে সমর্থন জোগাতে সাহায্য করে। যোগসূত্রগুলি এই দলগুলিকে পার্টি ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এবং পার্টির বার্তাগুলিকে শক্তিশালী করার বৈধতা প্রদান করে। পার্টিগুলি নিজেদেরকে ‘নির্বাচকদের দৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য’ করে তুলতে এবং তৃণমূলে সংহতি বাড়াতে সুশীল সমাজের সংগঠনগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার চেষ্টা করে। ঐতিহাসিকভাবে, ট্রেড ইউনিয়নগুলি নাগরিক সমাজের অঙ্গনে বামপন্থি দলগুলির সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র। যাইহোক, এই অত্যাবশ্যক নাগরিক সমাজ সংস্থার সঙ্গে বামপন্থি দলগুলির যোগসূত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে কর্তৃত্ববাদী যুগের কারণে যা ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে তাদের প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করেছিল। দেশভাগের পর, ১৯৬০-এর দশকে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের পাট ও বস্ত্র শিল্পগুলি বাম-আধিপত্যশীল শ্রমিক সংগঠনগুলির আবাসস্থল ছিল। শ্রমিক শ্রেণির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে এবং কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা চালাতে, খান ফ্যাক্টরি-লেভেল ইউনিয়নিজমের প্রবর্তন করেন যা দুর্নীতিগ্রস্ত ইউনিয়ন নেতাদের উপকৃত করেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতিকরণ অব্যাহত ছিল: আওয়ামী লীগ প্রশাসন (১৯৭২-৭৫) মূল শিল্পগুলিকে জাতীয়করণ করে এবং সমস্ত শ্রমিক ইউনিয়নকে একটি একক সংস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। সামরিক শাসন এই প্রবণতাকে দুভাবে বাড়িয়ে দেয়। প্রথমত, জিয়াউর রহমানের শাসনামল সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জন্য তাদের নিজস্ব লেবার ফ্রন্ট ঘোষণা করা বাধ্যতামূলক করে। এই পদক্ষেপ ইউনিয়নগুলির মধ্যে বিভাজনের সূচনা করেছিল এবং বামপন্থি দলগুলি শ্রমিক শ্রেণিতে তাদের আধিপত্যবাদী প্রবেশাধিকার এবং সংহতির ভিত্তি হারায়। দ্বিতীয়ত, উত্তরসূরি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামল অর্থনীতির অবিজাতীয়করণকে তীব্রতর করে এবং ক্রমবর্ধমান বেসরকারি খাত ইউনিয়ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ছিল। এটি ইউনিয়নবাদের মাধ্যমে বামপন্থি দলগুলির জন্য কৌশলের জায়গাকে আরও সঙ্কুচিত করে। কর্তৃত্ববাদের পরবর্তী যুগে, ট্রেড ইউনিয়ন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেরুকরণের খেলা শুরু করে। দুই বৃহৎ মধ্যপন্থি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ পরিচালনা করে। ক্ষমতায় থাকাকালীন, প্রতিটি দল শ্রমিক শ্রেণিকে তাদের নিজস্ব স্বার্থ সংঘঠিত করতে না দিয়ে তাদের নিজস্ব শ্রমিক ফ্রন্ট এবং ইউনিয়ন নেতাদের প্রচার করেছিল। এতদিনে বামপন্থি দলগুলো সাংগঠনিকভাবে এতটাই দুর্বল ছিল যে, এসব ইউনিয়নে তাদের উপস্থিতি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সঙ্গে মেলাতে পারেনি। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ ফ্রন্ট বামপন্থিদেরকে ছাড়িয়ে গেছে এবং বামপন্থি দলগুলো শ্রমিক অধিকার ও কল্যাণ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এবং উপযুক্ত কাজের পরিস্থিতির বিষয়ে এই দুর্বলতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বেদনাদায়কভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। যদিও বামপন্থি দলগুলি তাদের মূল নির্বাচনী এলাকায় যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না এমন বলা অন্যায্য হবে। চারটি বামপন্থি দলের অফিসিয়াল নথিগুলি ন্যূনতম মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রের অবস্থার উপর বিশেষ ফোকাসসহ শ্রমিক শ্রেণির অবস্থার উন্নতির জন্য একটি স্পষ্ট অঙ্গীকারের দিকে দিক নির্দেশ করে। তবে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য অর্জনের পথ কঠিন করে তোলে। একজন বামপন্থি রাজনীতিবিদ বলেছিলেন যে যদিও ট্রেড ইউনিয়নবাদ ব্যাপকভাবে কঠোর আইন, দালাল এবং ট্রেড ইউনিয়ন মাফিয়াদের দ্বারা ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তবুও বামপন্থি দলগুলি এখনো ইউনিয়নের মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা করছে। তার দৃষ্টিকোণ থেকে, বামপন্থিরাও কেবল কারখানার শ্রমিকদের একত্রিত করার দিকে মনোনিবেশ করছে না। যেহেতু গ্রামাঞ্চলে ক্ষেত-মজুররা (ক্ষেতমজুর) একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-শ্রেণির মানুষ, তাই তাদেরও একত্রিত করার জন্য বামপন্থি দলগুলি চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে, তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে বর্তমান বাংলাদেশে তৃণমূল স্তরে সংহতি আদর্শের চেয়ে কম। কোনো বামপন্থি নেতা সেভাবে তরুণ কর্মীদের প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হননি। বামপন্থি দলগুলো বাংলাদেশি ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন থেকে শুরু করে মানবাধিকারের উন্নতির লক্ষ্যে কয়েকটি লক্ষ্য ভাগ করে নেয়। যদিও দলগুলি এবং সুশীল সমাজের সংঘঠনগুলি কীভাবে সেই লক্ষ্যগুলি অর্জন করতে হবে তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে, তাই তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সহযোগিতা খুব কমই আছে।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের জন্য সুশীল সমাজের সংগঠনগুলির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলির শত্রুতার কারণে এই সম্পর্কও প্রভাবিত হয়। একজন পোড় খাওয়া বামপন্থি রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন যে, এই সুশীল সমাজ সংস্থাগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে বাইপাস করে রাজনীতিকে ‘বিরাজনীতিকরণ’ করার চেষ্টা করেছে। এই ধরনের প্রবণতা দুই ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সহযোগিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বামপন্থিরা মনে করে বেসরকারি (এনজিও) সংস্থাগুলি যেগুলি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ গঠন করে, সেই এনজিওগুলি বৈদেশিক অর্থায়নের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলো সাধারণত এই দলগুলোকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পুতুল হিসেবে দেখে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একাদশ পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি, ব্যাখ্যা করে কেন এনজিওগুলোকে সামাজিক সংস্কারে বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখা হয় না: ‘আজ দেশে এনজিওগুলো বড় ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে। বিশদভাবে বলতে গেলে, এনজিওগুলি দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং বেকারত্ব দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে সাম্রাজ্যবাদের ‘নিরাপত্তা বেষ্টনী’ হিসাবে কাজ করছে। .দারিদ্র্য বিমোচনের নামে গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে।
এই ক্রেডিট প্রোগ্রামগুলির উচ্চসুদের হার ঋণ খেলাপিদের বাধ্য করছে একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অন্য এনজিওতে ঋণ ফেরত দিতে। গ্রামীণ জনগণ দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পরিবর্তে ঋণের দুষ্টচক্রে আটকা পড়ছে। তাই দেশে দরিদ্র, চাপগ্রস্ত, ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে। ক্ষুদ্রঋণের এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এনজিওগুলো মুনাফা করছে। এনজিও’র নেতৃত্বে সংস্কার কার্যক্রম স্বল্পমেয়াদে কিছু সুফল বয়ে আনতে পারে। যদিও এই “সংস্কারের” বিরোধিতা করার কোনো কারণ নেই, তবুও এই সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের কর্তব্য। এনজিওগুলোর কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। তাই সবকিছু বিবেচনা করে বলা নিরাপদ যে এনজিওগুলো একটি নেতিবাচক এবং বিপজ্জনক ভূমিকা নিচ্ছে।’ এই অনুভূতি ডচই তার ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিধ্বনিত করেছে। দলটি ‘ব্যবহারিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামীণ মহাজন ও এনজিওদের ঋণের হাত থেকে কৃষক ও কৃষিকে বাঁচানোর’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বামপন্থি দল গণসংহতির নথিতেও, এনজিওগুলিকে গরিব গ্রামীণ জনগণের শিকার করা ঋণের হাঙর হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। ব্লুপ্রিন্টে, পার্টি ‘সার, বীজ, কীটনাশক বিক্রিকারী বহুজাতিক কর্পোরেশন, গ্রামীণ এনজিও এবং মহাজনদের ঋণের ফাঁদ থেকে কৃষকদের বাঁচাতে তার কার্যক্রম ঘোষণা করেছে।’ কিছু বিশেষজ্ঞ উদীচী বা ছায়ানটের মতো কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বাংলাদেশের প্রকৃত নাগরিক সমাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যাইহোক, এই বিশেষজ্ঞরা এটাও স্বীকার করেন যে স্বৈরাচারী আমলে ইচ্ছাকৃত রাষ্ট্রীয় নীতি সাংস্কৃতিক ইসলামের একটি রক্ষণশীল সংস্করণকে উন্নীত করেছিল, যা ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের ক্রমাগত এবং ধারাবাহিকভাবে সমর্থকদের একত্রিত করার ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল।
দলের মধ্যে ফাটল
বিশেষজ্ঞরা বামপন্থি দলগুলোর দুটি বড় দুর্বলতা হিসেবে অন্তর্দলীয় দ্বন্দ্ব এবং অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাবকে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রতি বামপন্থি সমর্থনে বিভাজন দেখা দেয়। আজকের বামপন্থি রাজনীতিবিদরা জাতীয় রাজনীতির এই সংজ্ঞায়িত মুহূর্তে বামদের ঐক্যবদ্ধ করতে না পারার জন্য অনুতপ্ত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, সামাজিক বিপ্লবের উপযুক্ত রূপ নিয়ে বিতর্ক এবং দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত শুধুমাত্র এই বিভাজনের জন্য দায়ী। রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্পর্কে সুসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৭৫ সালের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। একজন বামপন্থি রাজনীতিবিদ যিনি সেই সময়ে সক্রিয় ছিলেন তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে এই যুগ কীভাবে বামপন্থিদের সম্মিলিত শক্তিকে আরও ক্ষয় করেছে:- ‘বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে বামপন্থিরা কার্যত আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে। তারা একটি শক্তিশালী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেবে নাকি কিছুটা ক্ষীণ আন্দোলন করবে তা নিয়ে মতবিরোধের ফাঁদে পড়েছিল। ১৯৮০ থেকে ৯০ এর পুরো দশক জুড়ে বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত বামপন্থিরা ৭৫-পরবর্তী যুগ থেকে এই দ্বিধার শিকার হয়েছিল। তাদের কেউ এরশাদকে সমর্থন করেন আবার কেউ জিয়াকে সমর্থন করেন।
কেউ কেউ দল ছেড়ে এরশাদের দলেও যোগ দিয়েছেন। দিনের শেষে, বামপন্থিরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ বামপন্থি দলগুলো কর্তৃত্ববাদ পরবর্তী বাংলাদেশের উপদলীয় রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করে। কিছু বিশেষজ্ঞের মতামত ছিল যে, দলীয় মতপার্থক্য দলের মূল মতাদর্শে আঘাত করছে। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব, দলের মধ্যে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি, দলীয় সংঘাত মিটমাট করার অক্ষমতা, ব্যক্তিগত বিরোধ, দলীয় শৃঙ্খলার অনুপস্থিতি বামপন্থি দলগুলির মধ্যে ফাটলকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যাইহোক, একজন বিশেষজ্ঞ ভিন্নমত পোষণ করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, পুঁজিবাদী মিডিয়া বামপন্থিদের মধ্যে বিভাজন বৃদ্ধি করেছে এবং ভোটারদের কাছে তাদের দুর্বল হিসেবে উপস্থাপন করে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন যে, বিভাজন বামপন্থি রাজনীতিকে তিনটি উপায়ে প্রভাবিত করেছে: এটি তাদের ভোটারদের প্রভাবিত করেছে, জনবল এবং অর্থ উভয় ক্ষেত্রেই তাদের সাংগঠনিক শক্তি হ্রাস পেয়েছে এবং ক্ষমতায় থাকা কেন্দ্রবাদী দলগুলোর তুলনায় বামপন্থি দলগুলোর ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত দর কষাকষির ক্ষমতা কমে গেছে।
সামনে কী অপেক্ষা করছে ?
বামপন্থিরা তাদের রাজনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে যে চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে হবে সে সম্পর্কে এখনো সজাগ নন। এত চেষ্টা ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার পরও বাম ঐক্যের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাম দলের প্রভাব ও গণসংহতি শক্তি দুর্বল। এ ছাড়া তাদের অনেকের মধ্যে ত্রুটি, বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি রয়েছে। বামদের একটি অংশ ‘মহাজোট ২১’ এর অংশীদার এবং তাই তারা এখনো সরকারের অংশ। অন্যদিকে, কিছু বাম দল বিপ্লবী মনোভাব, জনগণ থেকে নিজেদের দূরত্ব বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতায় ভুগছে। এখনো পর্যন্ত এমন কোনো দৃশ্যমান প্রভাবশালী, প্রগতিশীল, বৃহৎ, সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তি নেই যারা বামদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাম-গণতান্ত্রিক জোট গঠন করতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞই অদূর ভবিষ্যতে একটি বামপন্থি পুনরুত্থান সম্পর্কে আশাবাদী নন। তাদের মধ্যে অনেকেই দেখেছেন যে, ইসলামের একটি বিশুদ্ধ, আচার-অনুষ্ঠানমূলক সংস্করণ দেশে প্রাধান্য অর্জন করছে, যা একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বামপন্থি মতাদর্শের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি ডানপন্থি দলগুলোর প্রতি সমর্থন বেড়েছে। একজন বামপন্থি নেতা তরুণ প্রজন্মের বামপন্থি মতাদর্শের প্রতি অনিচ্ছার জন্য হতাশা প্রকাশ করেছেন। তার দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশি সমাজে ভোগবাদী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং রক্ষণশীল ইসলামিক অনুশীলন এমন একটি পরিস্থিতির দিকে পরিচালিত করেছে যা এই প্রজন্মের কাছে বামপন্থি মতাদর্শকে অপ্রীতিকর করে তুলেছে।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তৃতীয় শক্তির উত্থান এবং রাজনৈতিক বৃত্তে দুটি চরমের পতনের পূর্বাভাস দিয়েছেন। তবে বর্তমান বাংলাদেশে কোনো বামপন্থি রাজনৈতিক দল সেই তৃতীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। কিছু বামপন্থি রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের সদস্যরা জনগণের পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক চাহিদার ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক এজেন্ডা তৈরির বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন। তারা ভেবেছিল যে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবনতি এমন একটি বিষয় হতে পারে যার উপর বামপন্থিরা কাজ করতে পারে। গ্যাস এবং কয়লার মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা এবং তার প্রচার আরেকটি বিষয় হতে পারে যেখানে বামপন্থিরা সমর্থন করতে পারে। সবচেয়ে আশাবাদী পর্যবেক্ষকরা বামদের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। একজন বামপন্থি নেতার সহকর্মী সংগঠনকে আরও মজবুত করার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বামপন্থিদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধ্যবাধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য বামেদের আদর্শগত সংহতি এবং সাংগঠনিক শক্তির উপর জোর দেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই স্বীকার করেছেন যে বামপন্থিদের কাজ করতে হলে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পদ্ধতিগত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে-যাতে বিরোধীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। একজন বামমনস্ক বিশেষজ্ঞ বলছেন, “আমরা একটি কার্যকর বিকল্প শক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি, যা আমরা চাই। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমতাবাদের জন্য যে ধরনের শক্তি দরকার তা আমাদের কাছে নেই। সামাজিক গণতন্ত্র দরকার, যা এখানে অনুপস্থিত।’
সূত্র: কার্নেগি এনডাউমেন্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন