দলীয় কোন্দলের জের ধরে নাটোরের সিংড়া উপজেলার পাকুরিয়া বাজারে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। দুই শতাধিক লোক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ হামলা চালায়।
হামলার ভিকটিমরাও ক্ষমতাসীন দলটির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের সংঘটিত এই হামলাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে ফেসবুকে বিতর্কিত স্ট্যাটাস দেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের স্ত্রী, সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আরিফা জেসমিন কণিকা। তাঁর স্ট্যাটাস ঘিরে এলাকায় বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকা মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর ভোট করা নিয়ে পাকুরিয়া গ্রামে আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সরকারি পুকুর দখল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠনে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলমের কাছে ভোটে হেরে যান সাবেক ইউপি সদস্য আলিফ হোসেন। তখন থেকে এলাকায় সংঘাত বাড়তে থাকে। পাকুরিয়া বাজার জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিয়োগ নিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর দুপক্ষের মধ্যে ওই বিরোধ নতুন রূপ নেয়। এর জের ধরেই সোমবার ওই হামলা চালানো হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাবেক ইউপি সদস্য আলিফ হোসেন ও ইটালী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে সোমবার তাদের কর্মী-সমর্থকরা পাকুরিয়া বাজারে হামলা চালায়। তারা জাহাঙ্গীর আলমের কার্যালয়, সাবেক ইউপি সদস্য ও ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুক্তা লাল চক্রবর্তীর মার্কেট এবং অ্যাডভোকেট মানিক লাল চক্রবর্তীর চেম্বারসহ ১০টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। দেশীয় অস্ত্র উঁচিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে তারা স্থান ত্যাগ করে। এ সময় গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এ ঘটনায় মামলা করেন সাবেক ইউপি সদস্য ও সাবেক ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তা লাল চক্রবর্তী। এতে তিনি ৭ জনের নাম উল্লেখ করেন ও অজ্ঞাতনামা ২৫০ জনকে আসামি করেন। আসামিদের মধ্যে আলিফ হোসেন ও ইটালি ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামের নাম রয়েছে।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের স্ত্রীর আরিফা জেসমিন কণিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন।
তিনি লেখেন, ১৯৭১ ও ২০০১ সালের মতো পাকুরিয়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। এ তাণ্ডবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ঘর থেকে বের হতে পারছে না। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।
স্ট্যাটাসে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের কাছে এর বিচার চান। তার সেই স্ট্যাটাস মুহূর্তেই ভাইরাল হয়, শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
বিকাল সাড়ে ৪টায় ঘটনাস্থলে আসেন নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ, পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান, নাটোর পৌরসভার মেয়র ও পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি উমা চৌধুরী জলি, সিংড়ার পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (সিংড়া) সার্কেল জামিল আকতার, এসি ল্যান্ড আল ইমরান, থানার ওসি নুর-ই-আলম সিদ্দিকীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, এটি মূলত ব্যক্তিগত রেষারেষি। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অ্যাডভোকেট মানিক লাল চক্রবর্তী বলেন, বিগত উপজেলা নির্বাচনে আমরা নৌকা মনোনীত প্রার্থী শফিকুল ইসলামের পক্ষে ছিলাম। আর হামলাকারী প্রতিপক্ষরা বিদ্রোহী প্রার্থী আদেশ আলীর পক্ষে ছিল। পরে আমাদের সমর্থনে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম ভোটে বিজয়ী হয়। এর পর থেকেই চেয়ারম্যান আরিফের সমর্থকরা আমাদের উপর ক্ষিপ্ত ছিল। তারা পরিকল্পিতভাবেই এই হামলা চালিয়েছে। আমার চেম্বার ভাঙচুর ও গুরুত্বপূর্ণ নথি লুট করে নিয়ে গেছে। জাতীয় জরুরি সেবায় (৯৯৯) ফোন করেও সময়মত সাহায্য পাইনি। বর্তমান ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছি। আমার দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আলিফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, পূর্ব বিরোধের জের ধরে ইটালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন এসে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে আমি জড়িত নই।
শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক পক্ষ থাকলে নাম আসবেই। তবে বিষয়টি নিয়ে আমি বিচলিত নই। ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। ঘটনাটি দুঃখজনক। এ বিষয়ে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন