সুপ্রিমকোর্টের ব্যারিস্টার আরমানকে মিরপুর ডিওএসএইচ-এর বাসা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে ৯ আগস্ট (মঙ্গলবার)। দীর্ঘ ৬ বছর আরমানের মা, স্ত্রী ও ছোট সন্তানরা অপেক্ষায় আছেন। কোথায় এবং কিভাবে তাঁকে রাখা হয়েছে জানেন না পরিবার।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তথাকথিত মামলায় আওয়ামী-বামদের ট্রাইব্যুনালে ফাঁসি রায় দেওয়া হয় আরমানের পিতা মীর কাসেম আলীকে। আওয়ামী-বামদের আদালতে রায়ের পর ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে বাড়ি থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় আরমানকে।
২০১৬ সালের ৯ই আগস্ট। রাত ১১টার দিকে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে কে বা কারা। ভেতরে থেকে পরিবারের লোকরা জানতে চেয়েছিলেন আপনারা কারা? জবাবে বলা হয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক। আরমানের পরিবারের সদস্যরা তখনই জানিয়েছিলেন, দরজা এমনভাবে কড়া নাড়তে ছিল মনে হচ্ছিল ভেঙ্গে ফেলা হবে। তাঁদের ফ্ল্যাটে উঠার আগে বাড়ির গেইটে দারোয়ানকে প্রহার করে আটকে রাখা হয়েছিল।
এক পর্যায়ে দরজা খুললে কমান্ডো স্টাইলে ঘরে প্রবেশ করেন আগন্তুকরা। তারা আরমানকে খুঁজতে থাকেন। আরমানের বোন এবং স্ত্রী জানতে চায় তারা কোন সংস্থার লোক। তাদের সাথে কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে কি না। কিন্তু এর কোন সদুত্তর দেয়নি। এক পর্যায়ে আরমান তাদের সামনে আসলে তাঁকে সঙ্গে যাওয়ার কথা বলেন। এই অবস্থায় আরমানকে নিয়ে বাড়ি থেকে নিচে নামেন। সামনে দাড়িয়ে থাকা মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। এরপর আর খোঁজ মিলছে না আরমানের।
আরমানের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছিলেন, আরমানকে নিয়ে যাওয়ার দুই দিন আগে ৭ আগস্ট ইউনিফর্মধারী র্যাব সদস্যরা এসেছিলেন আরমানের বাড়িতে। ওইদিনও তারা আরমানকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে বলেছিলেন। আরমান তখন জানতে চেয়েছিলেন তাদের সঙ্গে ওয়ারেন্ট বা কোন আদালতের আদেশ আছে কি না। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর র্যাবের সদস্যরা ওইদিন চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এর একদিন পরই আসেন সাদা পোশাকে সশস্ত্র অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা। আগন্তুকদের সবার সাথেই ছিল অস্ত্র।
আরমানকে অপহরণের পর গণমাধ্যমের কাছে যেভাবে ঘটনার বর্ণনা করেছিলেন মীর কাসেম আলীর মেয়ে তাহেরা তাসনিম।
তাঁর তখন গণমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন, "(৯ই আগস্ট) রাত এগারোটার দিকে আমাদের মিরপুর ডিওএইচএসের বাসায় কলিংবেল বেজে ওঠে। আমার ভাবী (আহমেদ বিন কাশেমের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার) দেখেন দরজায় ৬/৭ জন লোক। তাঁরা আমার ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমার ভাই (আরমান) তখন তাদের কাছে জানতে চান যে তাঁরা পুলিশ বা র্যাবের কিনা।
তাহেরা তাসনিম এর বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, তাঁরা (গুম বাহিনী) পাঁচ মিনিট সময় দেন ব্যারিস্টার আরমানকে প্রস্তুত হতে। গুম বাহিনী আরমানকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে বলেও জানান।
"আমারা তাকে যেতে দিতে চাইনি। আমার ভাইও তাদের সাথে যেতে অস্বীকার করেছিলেন। তারা জোর করে নিয়ে যান। আমার ভাইকে তারা একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যান। তাদের দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যই মনে হয়েছে"। এভাবেই সেই ভয়াবহ রাতের বর্ণনা তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে দিয়েছিলেন তাহেরা তাসনিম।
ব্যারিস্টার আরমানকে গুমের পর স্বজনেরা পল্লবী থানায় গিয়েছিলেন। তখনকার ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মানিক তাঁদেরকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা (পুলিশ) এই নামে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করেনি। থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হয়েছিল।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ব্যারিস্টার আরমান ছিলেন তার বাবা মীর কাসেম আলীর মামলার অন্যতম ডিফেন্স আইনজীবী।
জামায়াত আমীরের ফেইসবুক স্ট্যাটাস
নিজ ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক আবেগঘন বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। ফেসবুক বার্তায় জামায়াত আমির লেখেন, "প্রিয় আরমান। ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসিম! তোমার অপেক্ষায় আজ ছ’টি বছর পূর্ণ হলো। তোমার স্নেহময়ী মাতা, তোমার প্রিয় স্ত্রী এবং তোমার অবুঝ দু’টি কন্যা তোমার মুখ দেখেন না, তোমার কথা শুনেন না। তোমার মা এবং বাচ্চারা জড়িয়ে ধরে কপালে এখানে-সেখানে চুমু দেন না। হ্যাঁ, তুমি আমাদের দৃষ্টি সীমার ভিতরে না থাকলেও, কোথায় আছো আমরা না জানলেও, মহান রব, আ’লিমুল গায়িব, সামিয়ুম বাছির অবশ্যই জানেন এবং দেখছেন। তুমি নিশ্চয়ই রাব্বুল আলামীনের দৃষ্টির মধ্যেই আছো। জালিমেরা তোমাকে সে রাতে স্ত্রী-কন্যাদের বুক থেকে নিষ্ঠুরভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। দফায়-দফায় বড় কষ্ট দিচ্ছে তোমার মাজলুম পরিবার এবং তোমাকে। সব জুলুমেরই সীমা আছে। সব জালিমেরই শেষ আছে। এখানেও তার কোন ব্যতিক্রম হবেনা।
আমরা মহান মাওলার দরবারে নতশিরে তাঁর খাছ সাহায্য কামনা করি। তুমি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান-আল আযামীসহ যাদের সাথে এই জুলুম করা হয়েছে, মহান আল্লাহ তোমাদেরকে হেফাজতে রাখুন। স্ব-সম্মানে এবং সুস্থ হালতে প্রিয়জনদের বুকে ফিরিয়ে দিন। জুলুমের কালো রাতের অবসান হোক। মাজলুম জাতি মুক্তি পাক। ন্যায় এবং ইনসাফের সূর্য উদিত হোক। মহান প্রভুর কাছে কলিজার ভিতর থেকে সেই দো’য়াই করি"।
উল্লেখ্য, ফ্যাসিবাদি আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভিন্নমতের লোকদের ধরে নিয়ে গুম করার মত মানবতা বিরোধী অপরাধ শুরু করে। প্রথমে ২০১০ সালের জুন মাসে গুম করা হয় বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে। ২০১২ সালে গুম করা হয় বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস অলীকে। এভাবে সম্ভাবনাময় অনেক তরুণ বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকে গুম করা হয়। গুম করা হয়েছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের অনেক মেধাবী তরুণকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন