দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য কুশাসন, দুর্নীতিবাজদের প্রভাব এবং বিদেশে অর্থপাচারকে দায়ী করেছেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। সংবিধানের অন্যতম এই প্রণেতা বলেছেন, রাজনীতি এখন একটি অসৎ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি উত্তরণে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাবদল জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তবে খ্যাতিমান এ আইনজীবী বলেন, বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন এসব কথা বলেন। বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মনে করি এবং সবাই মনে করে এটা কোনো নির্বাচনই হবে না, এটা বানানো খেলা হবে। দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অন্যতম এই সদস্য। বলেন, সকল মানুষ যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে। সেটা সঠিকভাবে পুরোপুরি গণনা করা হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা এটা আমরা এতদিনেও করাতে পারিনি।
এতে আমাদের গণতন্ত্র পঙ্গু হয়ে আছে। রাজনীতিতে নিজের ব্যর্থতা-সফলতা প্রসঙ্গে ড. কামাল বলেন, এটাকে আমি ঠিক ব্যর্থতা বলবো না, এটা সফলতা।
আমরা নীতি মেনে চলি বলে চলমান রাজনীতি করতে পারিনি। কালো টাকাকে ব্যবহার করা, পেশি শক্তিকে ব্যবহার করা, ক্ষমতা দখল করার জন্য ভোট জোর করে বাক্সে ভরা এগুলো আমরা করিনি। যারা এসব করে ফেলছে তারা কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে আছে। রাজনীতিতে এখন ভালো মানুষের ভীষণ অভাব। ভালো মানুষ তো পেশি শক্তি, কালো টাকার আশ্রয় নেবে না। যারা এসবের আশ্রয় নিয়ে থাকে তারাই তো মাঠ দখল করে রাখে। পেশি শক্তির কারণে রাজনীতি থেকে মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে। ছাত্র সমাজ একটা ভালো শক্তি ছিল যারা সুস্থ রাজনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু ছাত্ররা এখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে। রাজনীতি এখন অসৎ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে কাজে লাগায় সরাসরি কালো টাকা উপার্জনের জন্য। দেশ থেকে যে টাকা পাচার হয়ে গেছে সে টাকা ফেরত আনা সম্ভব হবে কিনা জানতে চাইলে কামাল হোসেন বলেন, ফেরত আনা সম্ভব এটা বলা যেতে পারে। কিন্তু এটা কোনো দিনই হয় না। কারণ যারা টাকা নিয়ে গেছে তারা এটাকে রক্ষা করার জন্য বেশ তৎপর থাকে। পাচারকৃত টাকা ফেরত আনা প্রায় অসম্ভব। গত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে কামাল হোসেন বলেন, আমি মনে করি, না করার চেয়ে এটলিস্ট নির্বাচন করলে মানুষ মাঠে থাকে।
তারা রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হয় না। ওরাও যদি সরে থাকে তাহলে তো মাঠ পুরোপুরি ভরে থাকবে দুইনম্বরি দিয়ে। নির্বাচনে আসা উচিত যতটুকু সম্ভব। তবে এটাও মনে করি যে এটা খুব সম্ভবও নয় তথাকথিত যে নির্বাচন হয় এই নির্বাচন দিয়ে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বলছে নির্দলীয় সরকার না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না এ বিষয়ে ড. কামাল বলেন, তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তারা একথা বলছে। আমার মনে হয় অবস্থা বুঝে বলা যাবে। অবস্থা যদি এরকম থাকে যে মানুষের কথা তুলে ধরা যাবে তখন হয়তো সবাই মিলে চেষ্টা করা উচিত। বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই কমিশন নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে পারবে না। কমিশনে নিয়োগ করা হয় সেই সব লোকদের যারা ওরকম ভূমিকা রাখার শক্তি রাখে না ও মানসিকতা সে রকম নাই। সে রকম ব্যক্তিরা দায়িত্ব পাওয়ার পরে তাদের কাছে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা, নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করাও অবাস্তব। তিনি বলেন, বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে এর এক নম্বর কারণ হচ্ছে কুশাসন, দুর্নীতিবাজদের শাসন। সুশাসন দেশে না থাকলে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র না থাকলে জনগণের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা না থাকলে যা হয় সেটারই আমরা ভুক্তভোগী। এই সংকট কাটতে হলে জনগণের ঐক্য এবং কালো টাকার খেলাকে বন্ধ করতে হবে। আমাদের যেন শ্রীলঙ্কার পরিণতি না হয়। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আন্তর্জাতিক চাপ কতটা ভূমিকা রাখে? ড. কামাল বলেন, আন্তর্জাতিক চাপ হয়তো কিছু ভূমিকা রাখে।
কিন্তু নির্বাচন পুরোপুরি নিরপেক্ষ করতে তারা এগিয়ে আসে না। ড. কামাল হোসেন বলেন, এই বাংলাদেশের পরিবর্তন না আনলে সুষ্ঠু রাজনীতির মধ্য দিয়ে সৎ মানুষের নিয়ন্ত্রণ দেশে না আনতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ উৎপাদন করে, পরিশ্রম করে দেশকে দিতে চায়, যারা বিদেশে কাজ করে সবাই টাকা পাঠায়। কোটি কোটি টাকা তারা দেশে পাঠায়। অর্থাৎ দেশের মানুষের দেশপ্রেমের মাধ্যমে আমরা টিকে আছি এবং টিকে থাকবো ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন, সেই সৎ লোককে আরও সংগঠিত করা। দেশে জনগণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। সেই রাজনীতির মধ্য দিয়ে কার্যকর গণতন্ত্র দেশে চালিয়ে যাওয়া। নতুন প্রজন্মকে আমি এটাই বলতে চাই যে, আমাদের দেশে যে উজ্জল একটা অতীত আছে সেটা দ্বারা তাদের অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত। আমরা দেখিছি যে, কীভাবে আমরা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা জীবন সবাই যুদ্ধ করেছি। সফল যুদ্ধ করেছি যাতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি। আমি নতুন প্রজন্মকে আহ্বান জানাবো সুস্থ ছাত্র রাজনীতির। যে রাজনীতির মাধ্যমে ষাটের দশকে এত বড় বড় অর্জন হয়েছিল এদেশের গণতন্ত্র, সংবিধান সবই ছাত্র সমাজের আন্দোলনের ফসল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন