ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের সংঘাতের রেশ ধরে অস্থির হয়ে উঠছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। গত কয়েক দিন ধরে ঢাবি ক্যাম্পাস, দোয়েল চত্বর এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত চত্বরে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিও পালন করছেন উভয়পক্ষের নেতাকর্মীরা।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদল-ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাড়াও কয়েক রাউন্ড গুলিরও ঘটনা ঘটেছে। অস্ত্রবাজির বিষয়ে ছাত্রদল বলেছে- ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা হামলার সময় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ বলছে- অস্ত্রধারীরা ছাত্রদলের, তারাই অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার ও বহন করেছে।
গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া কয়েক দিনের সংঘর্ষ, হামলার ঘটনায় আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে শতাধিক। কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। হামলায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী অস্ত্রধারীদের ছবি প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এদের মধ্যে ঢাবির এসএম হল ছাত্রলীগকর্মী নাজিমুদ্দিন, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সহসভাপতি তিলোত্তমা, সাবেক চুয়েট সভাপতি সৈয়দ ইমাম, ছাত্রলীগকর্মী মাহমুদ চৌধুরী ও শহীদুল্লাহ হল সভাপতি শরিফ আহমেদসহ অন্তত ছাত্রলীগের ২০ নেতাকর্মীর চেহারা দেখা গেছে। কিন্তু গতকাল রাত পর্যন্ত ধরা পড়েনি অস্ত্রধারীরা। ছাত্রদলের অভিযোগ- অদৃশ্য কোনো ইশারায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
রক্তক্ষয়ী এ সংঘাত ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্র হওয়ায় সমালোচনা চলছে অনলাইনভিত্তি যোগাযোগমাধ্যমেও। নাগরিকদের অনেকেই বলছেন, দেশে সুস্থধারার রাজনীতিচর্চার যে অভাব রয়েছে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়ও দেখছেন অনেকে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে।
এদিকে ঢাবি ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সংঘর্ষ সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় আজ রবিবার থেকে ওই এলাকায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সুপ্রিমকোর্টে প্রবেশের মূল ফটক সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে বন্ধ থাকবে। তবে মাজার গেট স বসময় খোলা থাকবে।
শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, গত মঙ্গলবারের ঘটনায় শাহবাগ থানায় দুটি মামলা হয়েছে। অজ্ঞাত ৪০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদসহ সংগঠনের ১৮ নেতা ও অজ্ঞাত ৫০-৬০ জনের নামে একটি মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম। আর গত বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানান ওসি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই আল আমিন বলেন, ‘অপরাধী অপরাধীই; কে ছাত্রলীগ, কে ছাত্রদল- তা বিবেচ্য নয়। মামলার তদন্ত চলছে। জড়িত সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। হামলায় সম্পৃক্ততা পেলে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল ইসলামের দায়েরকৃত মামলার এজাহারে বলা হয়েছে- মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দোয়েল চত্বরসংলগ্ন কার্জন হলের সামনে ছাত্রদলের ১৭ নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জন লাঠিসোটা, রডসহ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়িভাবে মারধর করেন।
তিন দিন পর মামলা করার কারণ হিসেবে ছাত্রলীগ বলেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য মামলা করতে দেরি হয়েছে।
মামলার ১৭ আসামি হলেন- ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ, কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আকতার হোসেন ও সদস্যসচিব আমানউল্লাহ আমান, ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা ছাত্রদলের সভাপতি মেহেদী হাসান ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রাজিব হোসেন, কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সাইদুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইরফান আহমেদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আরিফুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাহফুজুর রহমান, ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম, ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি শাহিনুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি দেলোয়ার হোসেন, তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ফয়সাল দেওয়ান, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শামীম পালোয়ান প্রমুখ।
এদিকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ ঠেকাতে গতকালও ঢাবির বিভিন্ন পয়েন্টে স্টাম্প-কাঠ, লাঠিসোটা ও হেলমেট মাথায় নিয়ে অবস্থান করতে দেখা গেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। ক্যাম্পাসের মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি, কার্জন হল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় শনিবার সকাল থেকেই অবস্থান নেন তারা। যদিও অন্যদিনের তুলনায় শনিবার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঢিলেঢালা অবস্থানে ছিলেন। ছাত্রদলকে রুখে দেওয়ার সেøাগান আর ছাত্রদলবিরোধী বিভিন্ন গান গেয়ে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে তাদের। ক্ষণে ক্ষণে তাদের একটি অংশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মোটরসাইকেলে শোডাউন দিতেও দেখা যায়। তবে ছাত্রদলের কোনো নেতাকর্মী গতকাল ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্টে যারা তৎপর, তাদের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রক্টরিয়াল টিম তৎপর রয়েছে। মামলা হয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন