সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় থাকা উপকারভোগীদের দলের প্রাথমিক সদস্য করার উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিপুলসংখ্যক মানুষকে দলের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে নিয়ে আসতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে দলে প্রায় এক কোটি নতুন সদস্য যুক্ত হবে বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
পাশাপাশি এবার অন্য দলের কর্মী-সমর্থকদেরও সদস্য হওয়ার সুযোগ দিতে চায় আওয়ামী লীগ।
নানা সমালোচনার কারণে আগে বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত থেকে দলে লোক ভেড়ানো বন্ধ রাখা হয়েছিল। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখানেও ছাড় দেওয়ার kalerkanthoসিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
নতুন সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, এত দিন শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝেই দলের প্রাথমিক সদস্য হওয়া ও সদস্য পদ নবায়নের ফরম বিতরণ করা হতো। এবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তা সবার জন্য উন্মুক্ত করার অনুমতি দিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত এমন যে কেউ দলের সদস্য হতে পারবেন। তবে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের এ সুযোগ দেওয়া হবে না। নানা কারণে এত দিন বিএনপি বা অন্য দলকে যাঁরা সমর্থন করেছেন তাঁরাও আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবেন। তবে অন্য দলের সমর্থকদের আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের কমিটির নেতৃত্বের পদ দেওয়া হবে না।
গত ২ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তখন তিনি বলেছিলেন, সম্মেলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সদস্য সংগ্রহ ও সদস্য নবায়ন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংসদ ও দলের জাতীয় সম্মেলন এ দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
দলীয় সূত্র জানায়, ১৬ এপ্রিল ভোলা, ২১ মে ঝালকাঠি এবং ২৫ মে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রমের শুরু হয়। চট্টগ্রামে সদস্য ফরম বিতরণ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, যাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আনুগত্য রয়েছে, তাদের জন্য আওয়ামী লীগের দরজা উন্মুক্ত। ছোট পরিবার সুখী পরিবার, এই নীতিতে বড় দল চলতে পারে না। নবাগতদের যারা কাউয়া-হাইব্রিড বলে বিতাড়িত করতে চায়, তারা দলকে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে নিতে চায়। শুধু নিজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সারাজীবন দল চালিয়ে আওয়ামী লীগকে মুসলিম লীগে পরিণত করব?
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রাচীন একটি দল। এ দলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আরো ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, এর আগে বারবার দলের সদস্য সংগ্রহের বিষয়টি ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ঘটা করে উদ্বোধন করা হলেও সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম শেষ পর্যন্ত গতি হারিয়ে ফেলে। সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিন বছর পর পর সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন করা হয়। সদস্য পদ নবায়ন করা না থাকলে দলের কোনো কমিটিতে স্থান পাওয়া যায় না।
তবে দলের নেতারা জানান, নতুন সদস্য ও নবায়ন মিলে কখনোই ৪০ লাখের বেশি ফরম পূরণ হয়নি। অনেক সক্রিয় নেতাকর্মীও ফরম পূরণ করেন না। সে ক্ষেত্রে দলের বাইরের সরকারি উপকারভোগী প্রায় এক কোটি মানুষকে নতুন সদস্য হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্ত করার এই কার্যক্রম কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যেই সন্দেহ আছে।
সরকারের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ১২৩টি কর্মসূচি রয়েছে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এর মধ্যে আটটি কর্মসূচি নগদ ভাতার আর ১১টি খাদ্য সহায়তার। আগামী বাজেটে নতুন করে ১১ লাখ উপকারভোগীকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এতে সব মিলে এক কোটির কিছু কম বা বেশি মানুষ সরাসরি সরকারের উপকারভোগীর তালিকায় আসবে। এদের মধ্যে মুজিব বর্ষে ঘর পাওয়া দেড় লাখ পরিবারও আছে। এই উপকারভোগীদের আওয়ামী লীগের সদস্য করার জন্য তৃণমূলের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য উপকারভোগীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়েও নানা মত আছে। অর্থ বিভাগের তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে বয়স্ক ভাতা পান ৫৭ লাখ মানুষ। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা পান ২৪ লাখ ৭৫ হাজার জন। মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী পান দুই লাখ বীর মক্তিযোদ্ধা। প্রতিবন্দি ভাতা পান ২১ লাখ আট হাজার জন। সব মিলে এক কোটি চার লাখের বেশি মানুষ ভাতার আওতায় আছে। এ ছাড়া জেলে, বেদে, রূপান্তরিত মানুষরা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আছেন। তবে একই ব্যক্তি একাধিক ভাতাসহ নানা সুবিধা পাওয়ার অভিযোগও আছে। সে কারণে এই সংখ্যা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পরও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তৃণমূলের মানুষের তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় দেশের উন্নয়নের যে সুফল মানুষ ভোগ করছে তার ইতিবাচক ফলও ঘরে তুলতে পারছে না দলটি। আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ পরিবারকে বাড়ি উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই পরিবারগুলোকেও দলের সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের অবস্থান আরেকটু শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন নেতাদের কেউ কেউ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের কাউকে আমরা দলে নেব না। কিন্তু কারো খালাতো ভাই বিএনপি করে বলে তাকে আওয়ামী লীগের সদস্য করা যাবে না—এমনটা হওয়া উচিত নয়। আমরা দেখব, যারা দলের সদস্য হতে চায় তাদের আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কি না, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য আছে কি না। ’
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, কভিড মহামারি কমে আসার পরই দলের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ ও সদস্য পদ নবায়নে জোর দেয় আওয়ামী লীগ। গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় গণহারে দলের সদস্য সংগ্রহের বিষয়ে সম্মতি দেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপরই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সদস্য সংগ্রহ ফরম বিতরণ শুরু হয়। কয়েকটি জেলা, মহানগর ও উপজেলা কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছে।
দলের একাধিক সূত্র জানায়, সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আগের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ। এবার বিভিন্ন দলের তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হবে। আগামী নির্বাচনের আগে নিজেদের শক্তি বাড়াতে এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে।
এই উদ্যোগের ব্যাখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সমাজজীবনে বিপুলসংখ্যক মানুষ নানা শ্রেণি-পেশার সঙ্গে যুক্ত। তাদের দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা জরুরি। এটা মাথায় রেখে এবার ব্যাপকভাবে সদস্য সংগ্রহ করবে আওয়ামী লীগ। ’ তিনি বলেন, ছিন্নমূল যে মানুষগুলোকে সরকার বাড়ি করে দিয়েছে, যাঁরা সরকারের বিভিন্ন ভাতা ও সুবিধা পাচ্ছেন, তাদের দলের সদস্য করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন