বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই পরিচিত একটি শব্দ ‘তৃতীয় শক্তি’। ক্ষমতার গোঁড়ায় থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় ‘তৃতীয় শক্তি’ শব্দটি। ৮০’র দশকে কিছু বাম দল তৃতীয় শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টার কথা প্রচার করলেও ভাঙতে ভাঙতে এবং জনবিচ্ছিন্ন হতে হতে বাম শিবির প্রায় শেষ। নেতৃত্বে দৃঢ়তার অভাব, ব্যক্তিস্বার্থ, অদূরদর্শিতা, সুবিধাবাদিতা, পারিবারিক বিরোধ, লক্ষ্যহীনতা ও আপসকামিতায় অভ্যস্ত হয়ে বাম শিবির নিজের কবর খননে মগ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে বড় দুই দলের বাইরে তৃতীয় শক্তি সৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ইসলামি ধারার দলগুলোর মধ্যে।
গত শুক্রবার (১ অক্টোবর) বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়েছে শরিক দল খেলাফত মজলিস। এক প্রেস ব্রিফিং থেকে দলটি লিখিত বক্তব্যে জানায়, ‘রাজনৈতিক জোট ইস্যুকেন্দ্রিক গঠিত হয়। জোট কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। খেলাফত মজলিস ২০ দলীয় জোটে দীর্ঘ ২২ বছর যাবত আছে। ২০১৯ সাল থেকে ২০ দলীয় জোটের দৃশ্যমান রাজনৈতিক তৎপরতা ও কর্মসূচি নেই। ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে কার্যত রাজনৈতিকভাবে অকার্যকরও করা হয়। এমতাবস্থায় আদর্শিক, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, ২০১৯ সালের শূরা বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, খেলাফত মজলিস আজকের মজলিসে শূরার অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, খেলাফত মজলিস একটি আদর্শিক রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে স্বকীয়-স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে ময়দানে ভূমিকা রাখবে এবং এখন থেকে ২০ দলীয় জোটসহ সব রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করছে।’ এর আগে, চলতি বছরের গত ১৪ জুলাই বিএনপি জোট ছাড়ে শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। তারও আগে ২০১৬ সালের ৭ জুন বিএনপির জোট ছেড়ে যায় মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট। এ ছাড়া শোনা যাচ্ছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল থেকে বেরিয়ে আসবে অন্যান্য ইসলামি ধারার দলগুলোও।
এ দিকে, ইসলামি শাসনতন্ত্র কোনো জোটবদ্ধ না হয়ে আলাদা রাজনীতি করছে। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় একটি ফ্যাক্টর। ২০১৩ সালের তাণ্ডবের মাধ্যমে উত্থান হওয়া হেফাজতও করছে আলাদা রাজনীতি। গত কয়েকটি নির্বাচনে যদিও গড় ভোট কাস্ট কম হয়েছে, তবে ভোটের হিসেবে ইসলামি দলগুলো আগের তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছে। এর পাশাপাশি আফগানিস্তানে নতুন করে তালেবানের উত্থান ঘটেছে। আর বাংলাদেশের রাজপথেই এক সময় মিছিল বেরিয়েছিল ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। এবং স্বভাবতই তাদের এ খায়েশ এখনো মিটে নাই। ফলে ইসলামি ধারার এ দলগুলো নতুন জোট গঠন করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, ইসলামি দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এদের সম্মিলিত শক্তি যে কোনো বড় রাজনৈতিক দলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম। ২০১৩ সালে হেফাজতের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তির জানান দিয়েছিল এরা। এদের কাঁধে ভর করে ৫টি সিটিতে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছিল বিএনপি। অতীতে জাতীয় নির্বাচনেও ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত আমীর মুফতি ফজলুল হক আমিনী এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি মুহম্মদ ওয়াক্কাস ও সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুর পাশা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও এদের ভোট ও সমর্থন নিয়ে বহুবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছে বিএনপি। সুতরাং ভবিষ্যতে ধর্মভিত্তিক এই রাজনৈতিক দলগুলোর পৃথক জোট হলে ভোটের মাঠে বড় ধরণের প্রভাব রাখবে বলেই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণে ইসলামী দলগুলোই কি তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে? বর্তমানে এ প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতিসহ সকল মহলে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন