হেফাজত সরকারের নতুন একটি মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে হেফাজতের আমির আহমদ শফির মৃত্যুর পর প্রয়াত জুনায়েদ বাবুনগরী যখন আমির হয়েছিলেন তখন হেফাজত সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। বিশেষ করে ভাস্কর্য ইস্যুতে হেফাজত নেতাদের বেশ সরব দেখা গিয়েছিল। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তাণ্ডব চালায় হেফাজত। এরপর হেফাজতের নেতারা যেরকম উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে সরকারের উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। আওয়ামী লীগ অবশ্য খুব ঠাণ্ডা মাথায় এবং পরিকল্পিত ভাবেই হেফাজতকে পোষ মানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের আমির থাকা অবস্থাতেই হেফাজতের বেশ কয়েকজন নেতা যারা সরাসরি যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। আর মামুনুল হকসহ বেশ কয়েকজন হেফাজতের নেতাকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়। এরপরই হেফাজত অনেকখানি দমে যায়। জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এর পরপরই জুনায়েদ বাবুনগরী আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ওনার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে হেফাজতের আমির হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী একজন নরমপন্থী হিসেবেই পরিচিত। তার দায়িত্ব গ্রহণের ফলে হেফাজতের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোটামুটি তিনটি কারণে হেফাজত এখন আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসেছে। বরং আহমদ শফি ২০১৩ সালের মে মাসের পর যেভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে কাজ করেছিল, সেরকম একটি অবস্থায় হেফাজত ফিরে যাচ্ছে। এই কারণ তিনটি হলো:
১. সরকারের কঠোর অবস্থান: ২৬ শে মার্চ হেফাজতের নেতারা দেশের বিভিন্ন যায়গায় ত্রাস সৃষ্টি এবং তাণ্ডব চালিয়েছিল। তারপর কঠোর অবস্থান নেয় সরকার এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে আইনের আওতায় আনা হয়। এটি হেফাজতের মধ্যে একটি বার্তা দেয়। হেফাজত বুঝতে পারে যে সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে হেফাজতের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। ফলে হেফাজতের অধিকাংশ নেতাই কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসার পক্ষে মতামত দেয়।
২. হেফাজতের নেতৃত্বের পরিবর্তন: প্রয়াত জুনায়েদ বাবুনগরী আওয়ামী লীগ বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে তার মৃত্যু হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার একটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয়। বিশেষ করে নতুন আমির মহিবুল্লাহ বাবুনগরী অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত এবং আলেম সমাজের মধ্যে একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তার নেতৃত্বে আসার পর হেফাজতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
৩. কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা: বর্তমান সরকার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর এটি হেফাজতের তরুণদেরকে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিতে অনুপ্রাণিত করেছে। তারা মনে করছে যে অন্য সময় তারা কিছুই পায়নি। একমাত্র বর্তমান সরকারই কওমি মাদ্রাসার জন্য অনেক কিছু করেছেন। কাজেই যারা সুবিধা দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাওয়াটাকে বোকামি বলে মনে করছে হেফাজতের অনেকে। আর এ কারণেই হেফাজত পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। সরকারের সঙ্গে সহাবস্থানের মাধ্যমেই কওমি মাদ্রাসার যে সমস্ত দাবি দাওয়া সেগুলোকে নিয়েই হেফাজত এখন সরকারের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী বলেই হেফাজতের অধিকাংশ নেতারা মনে করছেন। এর ফলে মৌলবাদ নিয়ে সরকারের যে একটি বড় মাথাব্যথা ছিল সেটির অবসান হলো বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন