ঢাকা মহানগর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে আগে কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না এমন নেতৃত্ব দিয়ে গঠন করা হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার আহ্বায়ক কমিটি। দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম ছাড়া এই শাখার সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু এবং উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ও সদস্য সচিব আমিনুল হক কখনো ঢাকা মহানগর বিএনপির কোনো পদে ছিলেন না। স্বভাবতই যারা দীর্ঘদিন ধরে মহানগর বিএনপির রাজনীতি করছেন তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
দীর্ঘদিন মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পর অবশেষে এই কমিটি ঘোষণা করা হলো। অবশ্য বছরখানেক ধরেই কমিটি হওয়ার খবর শোনা যাচ্ছিল। গতকাল সোমবার বিকালে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে কমিটি গঠনের আগে ঢাকার মহানগরের সাবেক নেতাদের মতামত নেওয়া হয়নি। স্থায়ী কমিটিতেও কোনো আলোচনা হয়নি। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের চলতি দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ জানান, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন।
আমান ও সালাম দুজনই বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আমান ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সালাম অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মজনু যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আর আমিনুল বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক, তিনি জাতীয়
দলের সাবেক ফুটবলার। আমিনুল বিএনপিতে যোগ দেন ৫-৬ বছর আগে। অভিযোগ রয়েছে, মহানগরের রাজনীতি সম্পর্কে তার একেবারেই ধারণা নেই। কারাগারে থাকা বিতর্কিত এক ব্যবসায়ীর সুপারিশে তাকে উত্তরের সদস্য সচিব করা হয়েছে। আগের কমিটিতে উত্তরে আব্দুল কাউয়ুম এবং দক্ষিণে হাবিব উন নবী খান সোহেল সভাপতি ছিলেন। এবারের কমিটিতে তাদের রাখা হবে না বলে গত রবিবার রাতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আমানের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর উত্তরে ৪৭ সদস্যের এবং সালামের নেতৃত্বে দক্ষিণে ৪৯ সদস্যের কমিটি দিয়েছে বিএনপি। আগের কমিটির দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার, যুগ্ম সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিবকে কমিটিতে রাখা হয়নি। অথচ হাবিব ঢাকা মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে সবচেয়ে দূরদর্শী ও যোগ্য নেতা হিসেবে পরিচিত। উত্তরের সাধারণ সম্পাদক করোনা ভাইরাসে মারা যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করেন আবদুল আলী নকী। তাকে এবার প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে।
উত্তরের আহ্বায়ক হিসেবে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর নাম থাকলেও শেষ মুহূর্তে তাতে পরিবর্তন আসে। আবদুল সালামকে দক্ষিণের আহ্বায়ক করায় এ্যানীকে বাদ দিয়ে আমানকে উত্তরের আহ্বায়ক করা হয়।
আহ্বায়ক কমিটিকে কাউন্সিলের মাধ্যমে পরবর্তী কমিটি করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ঘোষিত কমিটির বেলা তা হয়নি। এ ছাড়া কমিটিতে পদ দেওয়ার ক্ষেত্রেও যোগ্যতা ও ত্যাগের মূল্যায়ন করা হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে। আগের কমিটির অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগরের প্রভাবশালী দুই নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার অনুসারীদের সমন্বয় করে দক্ষিণের নতুন কমিটি করা হয়েছে। আহ্বায়ক সালাম প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী। কমিটিতে খোকার অনুসারীর সংখ্যাই বেশি। মির্জা আব্বাসের অনুসারী রফিকুল আলম মজনুকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। ছাত্রদলের কয়েকজনকে মহানগর বিএনপিতে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি থেকে বহিষ্কৃত নাদিয়া পাঠান পাপনকে সদস্য করা হয়েছে। গতকাল সকালে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া ছাত্রদলের সাবেক নেত্রী আরিফা সুলতানা রুমাকেও সদস্য করা হয়েছে। এত জুনিয়র দুজনকে আহ্বায়ক করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মহানগরের নেতারা। বিগত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক তানভীর আহমেদ রবিনকে দক্ষিণের ৯ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক করাতেও বিস্মিত অনেকে। তার মতো একজন নেতাকে সিরিয়ালে এত পেছনে রাখায় তার অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
জানতে চাইলে আব্দুস সালাম বলেন, হাইকমান্ড আমার ওপর যে আস্থা রেখেছেন তা পালনে আপ্রাণ চেষ্টা করব। দক্ষিণ বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই হবে আমাদের লক্ষ্য। আমিনুল হক বলেন, হাইকমান্ড যে দায়িত্ব দিয়েছে তা সততার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করব। বিগত আন্দোলন সংগ্রামে যারা মাঠে ছিলেন তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত সব থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিটের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আগামীতে আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকা উত্তর সিটিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করাই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য।
২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থতার অভিযোগে ঢাকা মহানগরকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই বছরের ১৮ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে ৫২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্ত অভ্যন্তরীণ নানা কোন্দলে সেই কমিটি সফলতা দেখাতে পারেনি। দীর্ঘদিনেও তারা পুনর্গঠন করতে পারেনি থানা ও ওয়ার্ড কমিটি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাকে দুভাগ করে সংগঠনে গতি আনার উদ্যোগ নেয় বিএনপির হাইকমান্ড। ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগরকে দুভাগ করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। সোহেলকে সভাপতি ও কাজী আবুল বাশারকে সাধারণ সম্পাদক করে দক্ষিণে ৭০ সদস্যের এবং এমএ কাইয়ূমকে সভাপতি ও আহসান উল্লাহ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে উত্তরে ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটিও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে মহানগরকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। এ ক্ষেত্রে ৯০’র ছাত্রনেতাদের শীর্ষপদে আনার পরামর্শ দেন অনেকে। সেই পরামর্শের ওপর ভিত্তি করেই গঠন করা হয়েছে ঘোষিত কমিটি।
ঢাকা উত্তরের ১০ যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন আবদুল আলী, আনোয়ারুজ্জামান, আতিকুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, ফেরদৌসি আহমেদ, এ জি এম শামসুল হক, মোয়াজ্জেম হোসেন, আতাউর রহমান, আক্তার হোসেন ও গোলাম মোস্তফা। আর ৩৫ জন সদস্য হলেন- তাবিথ আউয়াল, ফয়েজ আহমেদ, শাহিনুর আলম, আবুল হাসেম, মাহফুজুর রহমান, আলাউদ্দিন সরকার, তুহিনুল ইসলাম, হাফিজুর রহমান, সোহেল রহমান, আক্তারুজ্জামান, আবুল হোসেন, শাহ আলম, এল রহমান, আফাজ উদ্দিন, আহসান হাবিব মোল্লা, সালাম সরকার, গোলাম কিবরিয়া, এ বি এম রাজ্জাক, তারিকুল ইসলাম, মো. ইউসুফ, আলী আকবর আলী, আহসান উল্লাহ চৌধুরী, মিজানুর রহমান, হুমায়ুন কবির, আমজাদ হোসেন, রেজাউর রহমান, মাহবুব আলম, হাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীর মোল্লা, আজহারুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, আফতাব উদ্দিন, হানিফ মিয়া, মোজাম্মেল হেসেন ও জিয়াউর রহমান।
দক্ষিণের কমিটিতে সবাইকে চমকে দিয়ে শেষ মুহূর্তে নেতৃত্বে আসেন আবদুস সালাম। মহানগর রাজনীতিতে তিনি বেশ পটু। দীর্ঘদিন মহানগর রাজনীতি করেছেন তিনি। সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তিনি মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এবং পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকা দক্ষিণ কমিটির ১২ যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন- নবী উল্ল্যাহ, ইউনুস মৃধা, মো. মোহন, মোশারফ হোসেন, আবদুস সাত্তার, সিরাজুল ইসলাম, আ ন ম সাইফুল ইসলাম, হারুন অর রশিদ, তানভীর আহমেদ, লিটন মাহমুদ, এস কে সেকেন্দার কাদির ও মনির হোসেন। আর ৩৫ জন সদস্য হলেন- ইশরাক হোসেন, ফরিদ উদ্দিন, গোলাম হোসেন, সাব্বির হোসেন, ফারুকুল ইসলাম, মকবুল হোসেন, আবদুল হান্নান, আরিফুর রহমান, আনোয়ার হোসেন, কে এম জুবায়ের এজাজ, ফরহান হোসেন, লতিফ উল্লাহ, মকবুল হোসেন সরদার, মোহাম্মদ আলী, আবদুল আজিজ, জামিনুর রহমান, শহিদুল ইসলাম, আকবর হোসেন, শামছুল হুদা, সাইদুর রহমান, এস এম আব্বাস, লোকমান হোসেন, জুম্মন হোসেন, ফজলে রুবায়েত, আবদুল হাই, মহিউদ্দিন চৌধুরী, আরিফা সুলতানা, সাইফুল্লাহ খালেদ, ওমর নবী, আবুল খায়ের, নাছরিন রশিদ, নাদিয়া পাঠান, হাজী নাজিম, জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী ও জামশেদুল আলম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন