গত রোববার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন ড. শামসুল আলম। তিনি সিনিয়র সচিব ছিলেন, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। মন্ত্রিসভায় তার অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে আমলারা আরও বেশি শক্তিশালী হলো এবং একটি সুস্পষ্ট বার্তা সকলকে দেয়া হলো যে দেশটা এখন আমলাদেরই কর্তৃত্বে। নিঃসন্দেহে ড. শামসুল আলম একজন মেধাবী অর্থনীতিবিদ এবং তার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ডেল্টা পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনায় তিনি ভূমিকা রেখেছেন এবং তাকে সরকারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু একজন অবসর গ্রহণ করা আমলাকে সরাসরি প্রতিমন্ত্রী করাটার মধ্যে একটি প্রতীকী বার্তা রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। ড. শামসুল আলমের সেবা সরকার অন্যভাবেও নিতে পারত। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়িয়ে দেওয়া যেত। এমনকি তাকে বিশেষ সহকারী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বা এরকম কোনো দায়িত্ব দেওয়া যেতো। কিন্তু তাকে সরাসরি মন্ত্রীত্ব দেওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে। মন্ত্রিসভায় রদবদল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথাবার্তা হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে।
এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেও নেতারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় মন্ত্রিসভায় রদবদলের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলেন। কিন্তু এই রদবদল না করে শুধুমাত্র একজন আমলাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করাটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এটি একটি ছোট্ট ঘটনা কিন্তু এটির একটি সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী একটি বার্তা দিলেন যে, রাজনীতিবিদরা নয় তিনি এখন আমলাদের ওপরই বেশি আস্থাশীল। কারণ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ধারণা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ২০৪১ সালের বাংলাদেশের রূপকল্প এবং ডেল্টা প্ল্যান এই দুটি বঙ্গবন্ধুর চিন্তা থেকে উৎসারিত এবং শেখ হাসিনাই এই পরিকল্পনাগুলোর প্রধান উদ্যোক্তা। আর ড. শামসুল আলম এ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছেন। তার মেধা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার প্রতিভা নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন যেটি একটি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের বিষয় সেখানকার একজন কর্মকর্তাকে মন্ত্রী করতে হবে কেন? যদি সরকারের তার সাহায্য সেবা নেয়ার প্রয়োজন হয় তাকে অন্যভাবেও সরকারের সঙ্গে রাখা যেত। কিন্তু সেটি না রেখে তাকে সরাসরি মন্ত্রিসভায় নেয়ার মধ্য দিয়ে আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব প্রকাশিত হলো বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও একজন আমলা। কিন্তু একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আমলাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে একটি ফ্ল্যাটগেট ওপেন হলো। এখন অনেক আমলাই তাদের দায়িত্ব শেষ করে মন্ত্রী হওয়ার জন্য চেষ্টা করবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। আগে আমলারা অবসর গ্রহণ করে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ার দখল করে নিতেন। এখন অনেক আমলা সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে সরকারের আপনজন সেজে অবসরের পরে মন্ত্রীত্বের চেয়ার দখল করতে পারেন বলেও মনে করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. শামসুল আলমের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের মধ্য দিয়ে একটি বার্তা সুস্পষ্ট হলো, তা হলো যে আমলাই এখন কর্তৃত্ববান এবং ভবিষ্যতে আরও আমলা যে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে সেটির পথ খুলে গেল। এর আগেও জ্বালানী উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আমলা থেকে সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মন্ত্রী হন নাই। ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম আমলা যিনি সরাসরি চাকরি থেকে ছেড়ে দিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তার ওই দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আমলাদের একটা একটা বিস্তৃতি ঘটেছিল। এখন ড. শামসুল আলামের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিবিহীন আমলারা চাকরির শেষে মন্ত্রীত্বের চেয়ারের জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন