করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক মাসের বেশি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। করোনামুক্ত হওয়ার বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েই গেছে। কারণ করোনা-পরবর্তী বেশকিছু জটিলতায় ভুগছেন তিনি। চিকিৎসকরা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকার কথা বললেও চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না নেতাকর্মীরা। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত এ উদ্বেগ কমবে না বলেও জানিয়েছেন তারা। এদিকে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে দোয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীতে দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় সারা দেশে বিশেষ দোয়ারও আয়োজন করা হয়।
দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ তথ্য নিয়মিত তারা পাচ্ছেন না। মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরাও এখন এ ব্যাপারে গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু অবহিত করছেন না। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মাঝেমধ্যে কিছুটা জানাচ্ছেন। নিয়মিত সর্বশেষ তথ্য জানতে না পারায় উৎকণ্ঠা আরও বাড়ছে। তবে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত এক চিকিৎসক বলেন, ‘চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে বাসায় না নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ করোনা-পরবর্তী জটিলতায় যে কোনো মুহূর্তে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে। তাই আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। যতদিন প্রয়োজন তাকে হাসপাতালেই রাখা হবে।’
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়া সারা দেশে নেতাকর্মী ও মানুষের কাছে একটা আবেগের নাম। তিনি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তার অসুস্থতার খবরে নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষও উদ্বিগ্ন। সবার প্রত্যাশা ছিল উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ যেতে তাকে সরকার অনুমতি দেবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অনুমতি দেয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়েই সরকার এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সবাই মনে করছেন।
তিনি বলেন, ‘চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও তিনি করোনা পরবর্তী বেশ কিছু জটিলতায় ভুগছেন। কিছুদিন আগে তার জ্বর হয়েছিল। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা করছেন। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা ভালো হলেও নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েই গেছে। সুস্থ হয়ে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত কেউ স্বস্তি পাবেন না।’
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগের কারণ প্রসঙ্গে দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী বলেন, করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। অবশেষে তার (খালেদা জিয়া) করোনা নেগেটিভ হয়। এ খবরে আমাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসার কথা। কিন্তু করোনা পরবর্তী জটিলতা দেখা দেওয়ায় আমরা আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। কারণ তার বয়স এবং আগের নানা জটিলতা থাকায় আমরা এমনিতেই চিন্তায় ছিলাম। দীর্ঘ কারাবাসে চেয়ারপারসন প্রয়োজনীয় উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক হলেন খালেদা জিয়া। আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসার জায়গা তিনি। শুধু নেতাকর্মী নন, সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার অসুস্থতায় জাতীয়তাবাদী পরিবারের প্রতিটি সদস্যই উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। সুস্থ হয়ে না ফেরা পর্যন্ত আমরা চিন্তামুক্ত হতে পারব না।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা এখন ভালো। কিন্তু করোনা আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থা যে কোনো সময় যে কোনো দিকে টার্ন নিতে পারে। তাছাড়া আগে থেকেই তিনি কয়েকটি রোগে ভুগছেন। তাই পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন তার হাসপাতালে থাকা নিয়ে সবাই চিন্তিত। তবে এখন পর্যন্ত তিনি ভালো আছেন। তার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।
যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু বলেন, ‘খালেদা জিয়া আমাদের কাছে মায়ের মতো। কোনো মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকলে কোনো সন্তানই চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন না। তেমনি আমরাও পারছি না।’
১১ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার করোনা শনাক্ত হয়। ২৭ এপ্রিল তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩ মে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) স্থানান্তর করা হয়। করোনা আক্রান্তের দুই সপ্তাহ পর দ্বিতীয় দফায় নমুনা পরীক্ষা করা হয়। সেখানেও ফল পজিটিভ আসে। ৪ সপ্তাহ পর ৮ মে তৃতীয় পরীক্ষায় তার করোনা নেগেটিভ হয়। করোনামুক্ত হলেও দেখা দেয় পরবর্তী জটিলতা। করোনা আক্রান্তকালে তার ফুসফুসে পানি জমে যায়। পানি অপসারণের জন্য দুটি পাইপ লাগানো হয়েছিল। বর্তমানে তা অপসারণ করা হয়েছে। এছাড়া মাঝেমধ্যে তার হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও ওঠানামা করে। করোনা পরবর্তী জটিলতা হিসাবে দেখা দিয়েছে কিডনি সমস্যা। ডায়াবেটিসও নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। মাঝেমধ্যে হার্টেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসব জটিলতা নিরসনে কাজ করছেন ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। ধীরে ধীরে এসব সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসছে বলে বোর্ডের এক চিকিৎসক জানান। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়ার অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেন খালেদা জিয়ার পরিবার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই আবেদন নাকচ করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন