শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতি-২৮
ছবির মতোই দেশের মানুষের স্মৃতি থেকেও ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে গুম হওয়া শত শত তরুণের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু, স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষত এখনও বুকে বহন করে চলেছেন স্বজনরা। নির্ঘুম রাত কাটে ওদের। প্রতিক্ষণ তারা থাকেন স্বজনের অপেক্ষায়। এমন শত শত পরিবারের সুখ-শান্তি নষ্ট করেছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর শাসনামলে গুম করা হয়েছে অনেক তরুণকে। গুম হওয়া বেশিরভাগই আর ফেরেননি। কারো কারো লাশ ভেসে উঠেছে নদীতে।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন পোক্ত করতে হিটলারের নিষ্ঠুর গেস্টাপো বাহিনীর কায়গায় বিএনপি, জামায়াত ও এর সহযোগী ছাত্র সংঠনের শত শত সদস্যকে গুম ও হত্যা করা হয়েছে।
“শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতি” শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ তুলে ধরা হয়েছে রাজধানীর সূত্রাপুর থানার ছাত্রদল নেতা সম্রাট মোল্লার গুম হওয়ার কথা।
সম্রাট মোল্লা ছিলের সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০১৪ সালের প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফটক থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সেই থেকে তার খোঁজ আর মেলেনি।
যেভাবে তুলে নেয়া হয়!
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্রাট মোল্লার এক আত্মীয় জানান, নির্বাচনের আগে এলাকায় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। এসময় সূত্রাপুর এলাকার এক ছাত্রদল নেতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। ২০১৩ সালের ২৮শে নভেম্বর সেই কর্মীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখতে যান সম্রাট ও অন্য কয়েকজন ছাত্রদল নেতা। সেখান থেকেই অস্ত্রের মুখে ডিবির লোকেরা তাদের সবাইকে তুলে নিয়ে যায়।
ঘটনাটি যারা দেখেছেন এমন অন্তত কয়েকজনের সঙ্গে সেদিন কথা বলেছিলেন সম্রাট মোল্লার স্বজনরা। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে তারা জানান, সম্রাট মোল্লা ও তার সঙ্গে থাকা ছাত্রদল কর্মীরা যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে যান, তখন ডিবির সশস্ত্র সদস্যরা সবাইকে অস্ত্রের মুখে তুলে নেন। লোকজন তাদের পরিচয় জানতে চাইলে ডিবির সশস্ত্র সদস্যরা পরিচয়পত্র দেখান। শত শত লোকের সামনেই সেদিন এভাবেই গুম করা হয়েছিল সূত্রাপুরে ছাত্রদলে জনপ্রিয় ছাত্রদল নেতা সম্রাট মোল্লাকে।
সম্রাটের সঙ্গে অন্য যাদেরকে তুলে নেয়া হয়েছিল, তারা হলেন, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি আনিসুর রহমান খান, একই ওয়ার্ডের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দল সম্পাদক মিঠু।
ডিবির মিথ্যাচার:
২০১৪ বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেভাগে দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে ধরপাকড় করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মূলত বিএনপি, জামায়াত ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর ওপরই নেমে আসে ব্যাপক জুলুম।
ক্ষমতা হারানোর ভয়ে কম্পমান আওয়ামী লীগ গেস্টাপো কায়দায় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার পথ বেছে নেয়। র্যা ব, পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা সদস্যদের ব্যবহার করে বিএনপি ও ছাত্রদলের মেধাবী নেতা-কর্মীদের গুম শুরু করে। অনেককে ধরে নিয়ে হত্যা করে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। সম্রাট মোল্লা ও অন্য ছাত্রল নেতাদেরকেও একই কায়দায় গুম করা হয়। এ কাজে ব্যবহার করা হয় ডিবিকে।
তবে, গুমের সঙ্গে নিজেদের জড়িত না থাকার কথা জানিয়ে পুরনো কায়দায় মিথ্যাচার করে ডিবি।
গুম হওয়া ছাত্রদল কর্মীরা ডিবিতে গেলে ভেতরেই ঢুকতে দেয়া হয়নি তাদেরকে। গেটের বাইরে থেকেই তাদের জানানো হয়, ‘দেখেন আমরা আনি নাই। আনলে জানাব।’
আদালতেও মিলছে না সুরাহা:
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসেবে অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের গত ১৩ বছরের শাসনামলে সারাদেশে ৬০৪ জনকে গুম করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগের সন্ধানই আর মেলেনি।
আওয়ামী লীগপন্থী মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গুম হওয়া ৬০৪ জনের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে। এছাড়া ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আর নিরবে ফিরে এসেছেন ৫৭ জন। অন্যদের খোঁজ কেউ দিতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের এই সময়কালের দু:শাসনে বিরোধীদল ও মতকে ব্যবহার করতে তারা ব্যবহার করছে র্যা ব, ডিবি, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। কখনও গভীর রাতে, কখনও বা প্রকাশ্যে বিরোধীদলের কর্মীদের তারা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, এসবের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েও কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
দালালিতে ব্যস্ত আওয়ামী মিডিয়া:
আওয়ামী দু:শাসন ও গুম-খুন ধামাচাপা দিতে আওয়ামী মিডিয়া গুলো তৎপর। ২০০৯ সালৈ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সহযাত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে আওয়ামী মিডিয়া। এসব গুম-খুনের বিষয়কে আওয়াম মিডিয়া গুলো গুরুত্ব না দিয়ে বরং এড়িয়ে গেছেন সব সময়।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যখন মুক্ত ও সুস্থ ছিলেন, তখন গুম নিয়ে ব্যাপক সরব ছিলেন আপোসহীন এই নেত্রী। ২০১৫ সালের ২৯শে আগস্ট তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন গুম হওয়া অনেক পরিবারের সদস্যরা। সেই সময় তিনি সব গুমের গুমের ঘটনায় জাতিসংঘের অধীনে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছিলেন।
বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী গুমকে একটি ‘ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান গুমের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যা শুরু হয়েছিল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে।
গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও গুম এক মহামারি আকার ধারণ করেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবাদ আর নিন্দার মুখেও থামছে না গুমের বিস্তার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন