আজ আমার জন্মদিন। কাগজপত্রে আমি ৬৭ কিন্তু আসলে ৭০। আজকের এই দিনে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত আমি কারাবন্দি। তাদের বাবার কথা চিন্তা করে আমান এবং আনা কী রকম অনুভব করছে? আল্লাহ্র কাছে হাজার শোকর যে, দেশের বাইরে হাসনা আজ ওদের সঙ্গ দিতে পারছে। হাসনা যদি আজ জেলে থাকতো কিংবা আটকা পড়ে যেত বাংলাদেশে তাহলে ওদের কী অবস্থা হতো ভেবে শিউরে উঠি আমি। যারা আমার বাড়ির ওপর হামলা চালিয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে ধরে নিয়ে গেছে, আমি নিশ্চিত যে, হাসনাকেও তারা ছাড় দিত না। আল্লাহ্র অশেষ করুণায়ই হাসনা ৭ই এপ্রিল দেশ থেকে বের হয়ে যেতে পেরেছে। এর আগে হাসনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ না করার ব্যাপারে হাইকোর্ট অপ্রত্যাশিতভাবে যে আদেশ দিয়েছে তাও ছিল মহান আল্লাহ্র আরেক অশেষ করুণা।
অত্যন্ত অস্বাভাবিক ধরনের বিবেচনাবোধ ও সহানুভূতির সঙ্গে বিচারপতি জনাব শাহ আবু নাঈম এই আদেশ দেয়ায় আমি তার কামরায় গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। প্রতিদিন ভোরে প্রার্থনার সময় এসব ঘটনা স্মরণ করে আমি মহান আল্লাহ্র দরবারে অশেষ শুকরিয়া আদায় করি। মাঝে-মধ্যে নিজেকে একজন নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হিসেবে মনে করেই আমি আল্লাহ্র দয়া কামনা করি এবং একমাত্র আল্লাহ্ই আমাকে ক্ষমা করে দায়ভারমুক্ত করতে পারেন।
আসমা, খোকন, শহীদ, আমির হোসেন এবং কবিরহাট থেকে দু’জন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। শহীদ এখন সামরিকদের প্রবলতর হুমকির সম্মুখীন। পরিস্থিতি খুব ভালো বলে মনে হচ্ছে না।
শুক্রবার ২৫ মে ২০০৭ দিন ৪৩
সকাল ৬টায় আমার ইবাদত শেষ হয়েছে। এরপর আমার বাহু ও পিঠের জন্য কয়েকটা হালকা ব্যায়ামের পালা। সোয়া ৬টা নাগাদ চেয়ারে বসে আমি আমার পরবর্তী প্রস্তাবিত বই বাংলাদেশ: এ স্টাডি অব ডেমোক্রেটিক রেজিম্স লেখায় মগ্ন হলাম। সাড়ে ৮টায় আমাদের নিজস্ব রসুইখানা থেকে নাস্তা আসে। রুটি, সবজি, মাঝে-মধ্যে একটা ডিম। আমার জন্য যে খাবারই বরাদ্দ করা হোক না কেন সবসময় তা আমি আমার সাহায্যকারী জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাই। কারণ আমি জানি যে, তার জন্য বরাদ্দ করা খাবারের পরিমাণ আমার চাইতে অনেক কম। বেলা ১টা পর্যন্ত আমি আমার লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে যাই। এর মধ্যে সাড়ে ৯টার দিকে একজন তরুণ শিক্ষিত বন্দি সুমনকে সাহায্যকারী হিসেবে নিয়ে কোনো কোনোদিন ডাক্তার আসেন আমাকে দেখতে। বেলা ১০টার দিকে খবরের কাগজ পাঠানো হয় আমার কাছে। ইত্তেফাক ও আমার দেশ। যেহেতু সংবাদপত্র স্বাধীন নয় এবং জরুরি অবস্থার অধীনে গণতন্ত্রের বালাই নেই সেহেতু সব পত্রিকার খবর প্রায় একই রকমের। আধঘণ্টার মধ্যে সব পড়ে শেষ করা যায়। বেলা ১টায় গোসল করার পর জোহরের নামাজ। দেড়টার দিকে রুটি, ডাল, সবজি, এক টুকরা মাছ বা মাংস বা মুরগিসহকারে খাওয়া। বেলা ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত একটু বিশ্রাম। তিনটা থেকে ৬টা আবার লেখাপড়ার কাজ। তারপর আসরের নামাজ শেষে বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাচলা। অতঃপর মাগরিবের নামাজ পড়া। সোয়া ৮টা পর্যন্ত সময় কাটে রেডিও টুডে শুনে, ডাইরি লিখে এবং এশার নামাজ পড়ে। এরপর ডিনারে লাঞ্চের সময়কার প্রায় একই মেনু। সোয়া ৯টায় কিরণ দেশাইয়ের বই নিয়ে চলে যাই বিছানায়। বইটির নাম দি ইনহেরিটন্স অব লস, যার কথা আগেও একবার উল্লেখ করেছি ।
শনিবার ২৬ মে ২০০৭ দিন ৪৪
পুব দিকের জানালা এবং দক্ষিণ দিকের দরজায় শক্ত গ্রিল লাগানো। কিন্তু তাতে মুক্ত আলো-বাতাসের চলাচলে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। ক্ষয়ে যাওয়া দেয়াল এবং বৃষ্টির সময়ে মেঝে প্লাবিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ক্রমশ আমি আমার ঘরটিকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। এজন্য মহান আল্লাহ্র কাছে আমার শুকরিয়া ও জেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ। আমার জন্য আনা ছোট্ট একটা টেবিলে রয়েছে আমার ফাইলপত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অন্য ছোট্ট একটা টেবিলে বই লেখার উপকরণসমূহ ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। দু’টি চৌকি, একটায় আমার বিছানা এবং অন্যটাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আমার অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে। বাসা থেকে আনা হয়েছে একটি টেলিভিশন তবে তা আমি দেখি না বললেই চলে। তবে আমার সামনে উন্মুক্ত জায়গায় আমি প্রত্যেকদিন দেখি অসংখ্য সুউচ্চ বৃক্ষের সারি আর শুনি দরজা ও জানালা দিয়ে প্রতিদিন সকালে ভেসে আসে পাখির কলকাকলী।
রবিবার ২৭ মে ২০০৭ দিন ৪৫
কোনো কোনো দিক থেকে জেল পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান একটা কারণ হলো ২০০২ সালে আমরা ক্ষমতায় থাকাকালে আমার উদ্যোগে জেল সংস্কারকে সরকার তার একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে বিবেচনা করে এবং আমার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার দরুন শেষ পর্যন্ত এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে কিছুটা সাফল্য আসে। এর অনেক দিন আগে ১৯৮০ সালে শহীদ জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো জেল সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। রাজনীতিবিদদের মতো জিয়াউর রহমানকে কোনোদিন জেলে যেতে হয়নি। কিন্তু তারপরেও কারাগারের সংস্কার নিয়ে তাঁর উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৮০ সালের সেই কমিশনের সুপারিশগুলো অবাস্তবায়িতই থেকে যায়। আমার চেয়ারম্যানশিপে জেল সংস্কারের ব্যাপারে একটা কমিটি গঠন করা হয় এবং ২০০২ সাল অবধি যা বাস্তবায়িত হয়নি সেগুলো বাস্তবায়নের বিষয়টিকে কমিটি তার মূল উদ্দেশ্য বিবেচনা করে এগিয়ে যায়। পরবর্তী চার বছরে কমিটি অসংখ্যবার বৈঠকে বসে এবং শতাধিক সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করে। এ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারকে আরো আধুনিক ও সুপরিসর করার জন্য কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত করা, জেলখানার খাদ্য, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন, সিলিং ফ্যান ও টেলিভিশন সরবরাহ করা, বন্দিদের প্রতি মানবিক ব্যবহার ইত্যাদি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল শতাধিক বছরের পুরনো জেল কোড পুরোপুরিভাবে পরিমার্জন করে এর আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করা। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি যে, ফেটার, ডান্ডাবেড়ি ও সামগ্রিক সাধারণ সেবাখাতসহ কতিপয় সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি এবং জেল কর্তৃপক্ষের মানসিকতার কোনো পরিবর্তনও আমি দেখিনি।
গত এক মাসে ডিআইজি কিংবা জেল সুপার মাত্র একবার আমাকে দেখতে এসেছেন। অথচ এর আগে রাজনৈতিক বন্দিদের খবরাখবর নিতে কমপক্ষে প্রতি দুইদিন অন্তর তারা একবার বন্দির সঙ্গে দেখা করে যেতেন।
সোমবার ২৮ মে ২০০৭ দিন ৪৬
এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সরকার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে কাউকে শাস্তি দিতে বা অপদস্থ করতে গিয়ে একটা নিজস্ব বাছাই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এর জন্য কোনো সুসামঞ্জস্য নিয়মনীতি বা ধারাবাহিকতার তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় কোনো একক নেতৃত্বের অস্তিত্ব নেই বলে, কে এবং কখন শেষ শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছে তা কেউই জানতে পারছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, যৌথবাহিনী এবং টাস্কফোর্স কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার হলো একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত সরকার এবং তারা ক্ষমতা নির্বিচারে প্রয়োগ করে যাচ্ছে। এও এক ধরনের দুর্নীতি। তারা কারা এবং কোন কর্তৃত্ব বলে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংস্কার আনার ব্যাপারে নির্দেশনা দিচ্ছে?
মঙ্গলবার ২৯ মে ২০০৭ দিন ৪৭
কোনো কোনো সময়ে আমি এই ভেবে দারুণ রকমের বিষণœতায় ভুগি যে, আমার সামনে উন্মুক্ত কোনো ভবিষ্যৎ নেই। হাজার রকমের চিন্তা ভিড় করে আসে আমার মনে। রাজনৈতিকভাবে আমার আর কানাকড়ি মূল্যও নেই। কোনো কিছুতে আর কোনো ধরনের অবদান রাখার সুযোগ আমার নেই। বেশ কয়েকটি সিভিল সোসাইটি সংস্থা আমাকে অবিশ্বস্ত একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচনা করে। এর প্রধান কারণ হলো, তারা আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত ও শত্রুভাবাপন্ন। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান ও শ্রদ্ধা আমি কখনো আশা করি না। দ্বিতীয়ত, আমার পরিবারের দিকে একবার তাকিয়ে দেখতে হয়। আনার বয়স এখন ২২। হাজার অসুবিধার মধ্য দিয়ে এগোতে গিয়ে তার প্রায় তিনটি শিক্ষা বছর নষ্ট হয়েছে এবং এখনো সে সংগ্রাম করে চলেছে। জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করার মতো মানসিক বিকাশ তার ঘটেনি।
আমার কপালে যা-ই থাকুক না কেন আমি তাকে নিষেধ করেছি বলে অদূর ভবিষ্যতে হাসনা দেশে ফিরে আসতে পারছে না। শেষত, ৭০ বছর বয়সে জীবনের শেষ প্রান্তকালে এসে দেখতে হচ্ছে যে, এক জংলী আইনের কারণে এমনকি সুপ্রিম কোর্টও কাজ করতে পারছে না। জামিনের কোনো অধিকার নেই এবং অনির্দিষ্টকাল এরা কাউকে কয়েদখানায় আটক রাখতে সক্ষম। আমার ভেতরে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আমি কতদিন টিকে থাকতে পারবো তা একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন।
আওয়ামী লীগ নেতা জলিল, বিএনপি’র প্রতিমন্ত্রী বাবর এবং ব্যবসায়ী হাশেমকে আরো অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বুধবার ৩০ মে ২০০৭ দিন ৪৮
শেখ হাসিনা বলেছেন যে, সরকারের বর্তমান অভিযান দুর্নীতির বিরুদ্ধে নয় বরং রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে।
আজ শহীদ জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। জরুরি আইনের প্রবল বিধিনিষেধের আওতায় এটি পালিত হচ্ছে।
আইন উপদেষ্টা মঈনুল হোসেন মাত্রাতিরিক্ত কথাবার্তা বলছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দুর্নীতি নিয়ে কোনো কথা বলা হচ্ছে না কেন? গ্রেপ্তারকৃতদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। কোনো কাজে কোনো সমন্বয় কিংবা নির্দেশনা নেই। মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই ফলদায়ক হয় না। দেশ আজ কোন্ পথে ধাবিত হচ্ছে? শোনা যাচ্ছে ২৬নং সেলকে আগের মতো পুরোপুরিভাবে ভিআইপি সেলে রূপান্তরিত করা হবে। তারেক রহমানকে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে মিনিট দশেক কথাবার্তা হলো।
(চলবে..)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন