কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার প্রাঙ্গণে স্থাপিত ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ শেখ হাফিজুর রহমানের অস্থায়ী আদালতে আজ মঙ্গলবার নাইকো মামলার শুনানি হয়। এ মামলার ১ নম্বর আসামি বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ছবি : এনটিভি
নাইকো দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠন করা হবে কিনা এ বিষয়ের ওপর শুনানিকালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবী বলেছেন, খালেদা জিয়া শুধু আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে চুক্তি বাতিল না করে তা বহাল রেখেছেন। এটা তো কোনো অপরাধ হতে পারে না।
আজ মঙ্গলবার কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার প্রাঙ্গণে স্থাপিত ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ শেখ হাফিজুর রহমানের অস্থায়ী আদালতে শুনানিকালে আইনজীবী এ মন্তব্য করেন।
বেলা ১১টার দিকে পিনপতন নিরবতার মাধ্যমে অসুস্থ থাকা খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এ মামলার শুনানি শুরু হয়। ইতোপূর্বে এ মামলায় খালেদা জিয়া ছাড়া অপর সব আসামির বিষয়ে শুনানি শেষ হয়েছিল। তার আগে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কারাফটক থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার ভেতরে সংরক্ষিত এলাকায় কারা কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত নিয়মশৃঙ্খলা মেনে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের আদালতে প্রবেশ করানো হয়।
বিচারকের এজলাসের সামনে অস্থায়ী এ আদালতের বাঁ পাশে কাঠগড়ায় আসামি গিয়াস উদ্দিন আল মামুনসহ তিনজন আসামি দাঁড়ানো ছিলেন। ডানপাশে প্রসিকিউশন টিম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। মধ্যে আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সঙ্গে ছিলেন জাকির হোসেন ও মেসবাহ উদ্দীন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল।
শুনানির শুরুতে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, এ মামলায় খালেদা জিয়া কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিসাধন ও দুর্নীতি করেছেন। নাইকো কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি করেছেন। যেহেতু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হোক।
এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অভিযোগ গঠন করা হবে কিনা তার কার্যক্রম শুরু হয়।
এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার শুনানি শুরু করেন। দীর্ঘ সময় তিনি মামলার এজাহারের কপি আদালতে পড়ে শোনান। এ সময় তিনি বলেন, বিজ্ঞ আদালত সিলেটের ছাতকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য ১৯৯৮ সালে নাইকো ছাতকসহ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র প্রান্তিক (পরিত্যক্ত) দেখিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ও নাইকো কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গ্যাস উত্তোলনে পূর্বের সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর নাইকো ও বাপেক্সের মধ্যে জয়েন্টভেঞ্চার চুক্তি ও গ্যাস ক্রয় চুক্তি সই হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সইয়ে স্বাক্ষর করেন। খালেদা জিয়া শুধু আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে চুক্তি বাতিল না করে তা বহাল রেখেছেন। এটা তো কোনো অপরাধ হতে পারে না। আর কানাডিয়ান কোম্পানির লিগ্যাল উপদেষ্টা হিসেবে সইয়ে মতামত দিয়েছিলেন মওদুদ আহমদ। এখানে খালেদা জিয়া তো শুধু আগের প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।
মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, এ ঘটনায় অপরাধ যদি হয়ে থাকে তাহলে পূর্বের সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার নামই সবার আগে আসা উচিত। শেখ হাসিনা সমঝোতা স্মারকে সাক্ষর করেছিলেন। খালেদা জিয়া শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। এ আদালতে আসতে হলে শুধু খালেদা জিয়া নয় শেখ হাসিনাকেও আনা উচিত। খালেদা জিয়া এ চুক্তি করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাজকে এগিয়ে নিয়েছেন। চুক্তিতে অবৈধ শব্দটা ব্যবহার করলে ‘অবৈধ’ কাজটা শেখ হাসিনাই প্রথমে করেছেন। দেশের উন্নয়নে ছাতকে গ্যাস ক্ষেত্র উত্তোলনের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রী সই করেন। অপরাধী হিসেবে এজাহারে খালেদা জিয়াকে আনা হলো রাজনৈতিক একটি উদ্দেশ্যে।
এ পর্যায়ে দুপুর ১২টার দিকে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত আজকে এ পর্যন্ত থাকুক। আমরা পরবর্তী তারিখে শুনানি করব।’
এ সময় বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আজকে তো মাত্র এক ঘণ্টা শুনানি করেছেন। কষ্ট করে এখানে এসেছেন। তাই আরও কিছুক্ষণ শুনানি করেন।’
জবাবে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত আমরা শুনানি শুরু করেছি। আমাদের আরও প্রস্তুতির দরকার আছে।’
বিচারক এ সময় বলেন, ‘আপনি তো শুনানির জন্য ভালোই প্রস্তুতি নিয়েছেন, আরও কিছুক্ষণ শুনানি করেন।’
জবাবে মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘হুজুর, আমরা যেহেতু শুনানি আজকে শুরু করেছি। তাই শেষও করব। আজকে এটুকু পর্যন্ত থাকুক।’
এ সময় দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল শুনানি মুলতবির পক্ষে মতামত দিয়ে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, আইনজীবী বন্ধু মাসুদ আহমেদ তালুকদার কথা বললে সেটা তিনি রাখেন। এ জন্য মুলতবি রাখা যেতে পারে।’
এ সময় বিচারক বলেন, ‘অফিসের সময় অনুযায়ী বিকেল ৪টা পর্যন্ত শুনানি করা উচিত।’
পরে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের সম্মতির সময় থাকায় প্রথমে ৮ মার্চ শুনানির দিন নির্ধারণ করতে বলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ১০ ও ১১ মার্চ। এ জন্য ১৮ মার্চ দিন ধার্য করেন।’
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলও তাতে সমর্থন দেন। পরে আদালত ১৮ মার্চ এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিসাধন ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম তেজগাঁও থানায় খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
২০১৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এতে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত এ কে এম মোশাররফ হোসেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, বাগেরহাটের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ এইচ সেলিম ও নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।
জানা গেছে, ছাতকের গ্যাস কাঠামোর মধ্যে একটি ফাটল রয়েছে। তাই এটি ছাতক পূর্ব ও ছাতক পশ্চিম নামে দুই ভাগে বিভক্ত। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম ৭৫ কিলোমিটার সিসমিক সার্ভে করে ছাতক পশ্চিমে গ্যাসের সন্ধান পায়। এরপর ১৯৬০ সালে এখানে প্রথম কূপ খনন করা হয়। দুই হাজার ১৩৫ মিটার পর্যন্ত খোঁড়া হয়। এর মধ্যে এক হাজার ৯০ মিটার থেকে এক হাজার ৯৭৫ মিটারের মধ্যে নয়টি গ্যাসসমৃদ্ধ স্তরের (স্যান্ডস্টন) সন্ধান মেলে। এখানে ২৬৫ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস রয়েছে। এর মধ্যে ২৬ বিসিএফ তোলা হয়েছে। ছাতক পূর্বে এখনো কোনো অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়নি।
এদিকে, অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি ওয়েলড্রিলের ১৯৯১ সালের জরিপ মতে, ছাতকে সাত টিসিএফ গ্যাস রয়েছে।
১৯৬০ সালে ছাতক-১ নামে এই কূপ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্যাস তোলা শুরু হয়। এখান থেকে দৈনিক ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাস তোলা হতো। এই গ্যাস ছাতক সিমেন্ট ও পেপার মিলে সরবরাহ করা হতো। ১৯৮৪ সালের পর গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে ওয়ার্কওভার করা হলেও তা সফল হয়নি। এরপর গ্যাসক্ষেত্রটিতে আর অনুসন্ধানকাজ চালানো হয়নি।
১৯৯৮ সালে নাইকো ছাতকসহ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র প্রান্তিক (পরিত্যক্ত) দেখিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেয়। ১৯৯৯ সালে নাইকো ও বাপেক্স একটি যৌথ সমীক্ষা চালায়। সে সময় বাপেক্স ছাতক পূর্ব গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক ঘোষণার বিষয়ে আপত্তি জানায়। ২০০১ সালের পর ছাতক পূর্ব ও পশ্চিমকে একটি গ্যাসক্ষেত্র দেখিয়ে পুরো গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর নাইকো ও বাপেক্সের মধ্যে জয়েন্টভেঞ্চার চুক্তি ও গ্যাস ক্রয় চুক্তি সই হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন