সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ব্যাপক ‘কারচুপি’ পর পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়েছে বিএনপি। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচনে আর অংশ নেবে না দলটি।
অবশ্য দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলছেন, আগামী নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ সরকার দাবি আরও জোরালো এবং নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপে রাখাসহ কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্তটি এমন সময় ঘোষণা করল যখন ১১ এপ্রিল থেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী নেতা মনে করেন, এই সিদ্ধান্তে সরকার দারুণ চাপে পড়বে। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি মহলের কাছে এর জন্য সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে। তাদের অধীনে কোনো নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়- এটা সবার কাছে প্রমাণ করতে পেরেছে বিএনপি। ফলে আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতামতে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া সরকারের হাতে বিকল্প থাকবে না।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সূত্রে জানা যায়, বিএনপির ভাষ্য অনুযায়ী ‘২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগের রাতে হয়েছে’। এই অভিযোগ তুলে সে সময় এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্ট। এমনকি জাতীয় সংসদে না যাওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দলটি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে অটল না থাকায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে বিএনপিকে।
দলের স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য দলীয় ফোরাম ও ফোরামের বাইরে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিলেন। ২০ দলীয় জোটের শরিক ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বিএনপির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে জোটই ছেড়ে দেন। জামায়াত জোটে থাকলেও বিএনপির এসব সিদ্ধান্তে চরমভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে দলটি। বিএনপি দলের সিদ্ধান্তে অটল থেকে উপনির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, পৌরসভা-উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। প্রতিটি নির্বাচনেই নানা অনিয়ম এনে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে শেষ করে।
সম্প্রতি এই নিয়ে স্থায়ী কমিটির কয়েকটি বৈঠকে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু গত শনিবার অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সব সদস্য একমত পোষণ করায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এখানে অন্তত সরকার একটা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করবে, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার গ্রহণ করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদসহ পৌরসভা-উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে যা হয়েছে, তাতে আগামীতে ইউনিয়ন পরিষদের অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে অংশ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি আমরা দলীয়ভাবে।’
ফখরুল বলেন, বিএনপি গণতন্ত্রের বিশ্বাস করে বলেই চরম প্রতিকূল অবস্থায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এই নির্বাচন কমিশন কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করবার যোগ্য নয়। বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই এই নির্বাচন কমিশনের কাজ।
আগামীতে সব নির্বাচনেই অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন কিনা প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এটা আমাদের স্ট্যাডিং কমিটির সিদ্ধান্ত হলে জানাব। এখন পর্যন্ত আমাদের পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আমরা আর দলগতভাবে যাচ্ছি না। ইউনিয়ন পরিষদে আমাদের দলের কাউকে মনোনয়ন আর দিচ্ছি না।
গত শনিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বিএনপির আগামী নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বেশ কিছু কারণও আছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আর বেশি দিন নেই। সেক্ষেত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের পাশাপাশি নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে চলমান আন্দোলন আরও জোরদার করবে বিএনপি। সে অনুযায়ী জাতীয় ঐক্য করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকেও ঢেলে সাজানো হচ্ছে। মেয়র প্রার্থীদের উদ্যোগে বিভাগীয় শহরে সমাবেশ চলছে। সব মিলিয়ে সরকারকে চাপে রাখতে হলে রাজপথে সক্রিয় হতে হবে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা জানান, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আরও কিছু বিষয় আমলে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূলের যোগ্য নেতাকর্মীরা মনোনয়ন ফরম কেনে না। ফলে অপেক্ষাকৃত অপরিচিতদের মনোনয়ন দিতে হয়। এসব প্রার্থীকে দলের নেতাকর্মীরাও সহযোগিতা করে না। আবার নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সবাইকে নির্যাতিত হতে হয়। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা থামছে না। ভোটের মাঠে সরকারি দলের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সব আয়োজন থাকে। রাষ্ট্রীয় শক্তি যেখানে নির্বাচন কারচুপির সঙ্গে জড়িত থাকে, সেখানে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। কারচুপির রেকর্ড এমন পর্যায়ে যে কোনো কোনো কেন্দ্রে শূন্য ভোট পাওয়ারও রেকর্ড আছে। দেশের গণমাধ্যমও সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারছে না। এসব ঘটনায় তৃণমূলে সংগঠন দুর্বল হচ্ছে। যা আন্দোলন-সংগ্রামে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত দলের মহাসচিব গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাই আমার বক্তব্য।’ তিনি বলেন, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই যখন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে না; তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এখন দেশে ভোট হয় না, তা দেশি-বিদেশিদের কাছে আমরা প্রমাণ করেছি। জনগণও চায় না এই ধরনের নির্বাচন বিএনপি আর অংশ গ্রহণ করুক।
ইউপি নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়ার ঘোষণা প্রসঙ্গে জানাতে চাইলে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেন, নির্বাচন কমিশন সব সময় চায়, প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। আমাদের কাছে যে সহযোগিতা চাইবেন, নির্বাচন কমিশন সে বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান করবে।
বিএনপির এ ঘোষণায় ইসি কোনো প্রশ্নের মুখে পড়ল কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, সেটি দেখা যাক। এখানো তো তফসিল ঘোষণা করিনি। তফসিল ঘোষণার সময় আমরা বিষয়টি দেখব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন