পিতা ফিরে আসবেন। এই অপেক্ষায় পল্লবী থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুর আলমের ৩ সন্তান। স্ত্রী পথ চেয়ে আছেন, স্বামী ফিরবেন। পুত্ররা এই অফিস থেকে সেই অফিসে ধরনা দিচ্ছেন ৬ বছর যাবত। পিতাকে খুঁজে পেতে পুত্রদের অনন্ত চেষ্টা চলছে। র্যাব, পুলিশ, ডিবি কোথায়ও যাওয়া বাকী নেই। মানবাধিকার সংগঠন গুলোর কাছেও তাদের আবদার, পিতাকে একটু খুঁজে দিন।
ঢাকার পল্লবী থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি যুবদল ঢাকা উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর ৩ সন্তানই এখন বড় হয়েছেন। তারা অপেক্ষায় পিতা একদিন ফিরে আসবেন। সন্তানদের কাছে ডাকবেন। পিতাকে জড়িয়ে ধরবেন সন্তান। এমন একটি দিনের জন্য অপেক্ষা পরিবারের সবাই। দিন গুনতে গুনতে ৬ বছর পার হয়ে গেছে এই ফেব্রুয়ারীর ১২ তারিখে। অপেক্ষার অবসান হচ্ছে না।
আদৌ ফিরবেন কিনা সেটাও তো নিশ্চিত নয়। তারপরও বেঁচে আছেন এবং ফিরবেন এমনটাই প্রত্যাশা নুর আলমের স্ত্রী সন্তানদের।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারীকে সামনে রেখে বিরোধী জোট অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদি সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের নামে প্রহসনের আয়োজন করে ক্ষমতা ধরে রাখে। সেই ৫ জানুয়ারীকে সামনে রেখেই অসহযোগের ডাক দেওয়া হয়। বিরোধী জোটের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে দেশ প্রায় অচল তখনো। বিরোধী জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গুলশানের কার্যালযে বন্দি। ২০১৪ সালের ওই নির্বাচনে বিরোধী জোট অংশ নেয়নি। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। সকলের দাবী ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। এর আগে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেন সংবিদান থেকে। নিজের অধীনে নির্বাচনে আয়োজন করেন তিনি। প্রতিবাদে বিরোধী দল গুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল তখন। তবে শেখ হাসিনা একতরফা নির্বাচন আয়োজনে অনঢ়। এই নির্বাচনের এক বছর পূর্তি হওয়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবী তখন বিরোধী জোটের। এই দাবীতেই ডাক দেওয়া হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনে। এই আন্দোলন দমনের নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলোকে ব্যবহার করে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের গুম এখন খুনে মেতে উঠেছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি সরকার।
আন্দোলন চলাকালীন যুবদল নেতা নুর আলমের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দেয় পুলিশ। গ্রেফতা ও গুম-খুনের ভয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে গাজিপুরের জয়দেবপুরে গোপনে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভাইয়ের বাড়িতে। তাতেও রক্ষা হয়নি। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে পুলিশ নুল আলমের ঠিকানা খুঁজে পায়। ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে গাজিপুরের জয়দেবপুরে সেই বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতে চায় কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জবাবে বলা হয়েছিল, লোকাল থানায় খোঁজ নিয়েন।
কিন্তু পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁর আর খোঁজ মিলছে না। অনেক খোঁজাখুজির পর পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। ঘটনার ১৪ দিন পর আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে নুর আলমের স্ত্রী রীনা আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তাঁর স্বামীর নামে বেশ কয়েকটি মামলা দেওয়া হয়। গ্রেফতার এড়াতে গাজিপুরের জয়দেবপুরে এক ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ১২ ফেব্রয়ারী রাতে বাড়ির দেওয়াল টপকে পুলিশ প্রবেশ করে বাউন্ডারির ভেতরে। তারপর ঘরে ঢোকে পুলিশ। তাদের সঙ্গে ছিল অস্ত্র ও বিশেষ একটি যন্ত্র। বাড়িতে প্রবেশের পরই সবার মোবাইল তারা নিয়ে নেয়। যাওয়ার সময় নুর আলমকে সঙ্গে নিয়ে যায় একটি মাইক্রোবাসে করে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন। জবাবে জানানো হয়েছিল, লোকাল থানায় যোগাযোগ করতে। কিন্তু থানায় যোগাযোগ করে কোন হদিস পাওয়া যায়নি। সংবাদ সম্মেলনে নুর আলমের স্ত্রী আকুতি জানিয়েছিলেন স্বামীকে ফেরত দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁর আকুতি কেউ শোনেনি। জনগনের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিরাপত্তার বদলে নুরে আলমকে ধরে নিয়ে বরং গুম করে রেখেছে।
অনেক খোঁজাখুজির পর পরিবারের পক্ষ থেকে ২০১৫সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী থানায় একটি জিডি করা হয়। পরবর্তীতে ১৭ জুন (২০১৫) পুলিশকে আসামী করে একটি মামলা দায়েরের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশকে দায়ী করায় মামলা নিতে চায়নি থানা। পরবর্তীতে ভাষার পরিবর্তন করে পুলিশের পরিচয়ে নুর আলমকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে লিখে মামলা দায়ের করলে সেটা গ্রহন করা হয়। কিন্তু দুই বছর পর চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। অর্থাৎ কাউকে দায়ী না করে মামলাটির রিপোর্ট দেওয়া হয় আদালতে। মামলা করেও নুরে আলমের পরিবার সুরাহা পায়নি রাষ্ট্রের কাছে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় সাদা পোশাকে পুলিশের সদস্যদের পাশাপাশি পোশাকে ইউনিফর্মসহ পুলিশও সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কাজ কি? জনগনের টাকায় বেতন নিয়ে বিরোধী দলের কর্মীদের গুম করাই কি রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলোর কাজ? দায় এড়াতে পারবেন কি গাজিপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার ও লোকাল থানার ওসি?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন