সিলেট বিভাগে দ্বিতীয় ধাপের ৭ পৌরসভার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চার, বিএনপি দুই ও বিদ্রোহী-স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি পৌরসভায় বিজয়ী হয়েছেন। পাশাপাশি বিদ্রোহীরা এগিয়ে গেলেও খোদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়ন বাজেয়াপ্ত হয়েছে কোথাও কোথাও।
নির্বাচনের এমন ফলাফলের পর চলছে নানা বিশ্লেষণ। আলোচনা চলছে জয়-পরাজয়ের নেপথ্য কারণ নিয়ে। এরসঙ্গে নানা কথা, নানা গুঞ্জনও রয়েছে মাঠে। দুটি প্রধান দলের মাঠের তৃণমূল কর্মীদের পর্যবেক্ষণে পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল। এমন সমালোচনা দুটি দলের অভ্যন্তরেই। তবে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল হলেও আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিতে বিদ্রোহীর মহড়া ছিল না।
বিশ্লেষক ও দলীয় নেতাকর্মীদের বৃহৎ অংশের দাবি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কুপোকাত হয়েছেন দলীয় কোন্দল আর বিদ্রোহীদের কারণে। বিএনপির পরাজয়ের জন্য সংগঠনের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন দলের ত্যাগীরা।
অপরদিকে আড়ালে তৎপরতা চালানোর চেষ্টায় থাকলেও প্রকাশ্য নির্বাচনে অনেকটা নিখোঁজ ছিল জামায়াত। বিএনপির প্রার্থীরাও জামায়াতের সহযোগিতা ও সমর্থন পাননি। জামায়াত পাশে না থাকলেও প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় হবিগঞ্জে অনুষ্ঠিত তিনটি পৌরসভার নির্বাচনেই বিজয়ী হয়েছে বিএনপি।
দ্বিতীয় দফার আগে সিলেট বিভাগে অনুষ্ঠিত প্রথম দফায় পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২ ও বিএনপি একটি পৌরসভায় বিজয়ী হয়। সুনামগঞ্জের দিরাই ও মৌলভীবাজারের বড়লেখায় আওয়ামী লীগ ও হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে বিএনপি জয়ী হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দফা মিলিয়ে সিলেট বিভাগে মোট ১০ পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।
হবিগঞ্জে ভরাডুবি হয়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের। অথচ জামায়াত পাশে না থাকা সত্ত্বেও নৌকা ডুবিয়ে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল এ ভরাডুবির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। এরসঙ্গে শাসক দলের পরিচয় দিয়ে নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর মহড়াও ভরাডুবির কারণ।
মাধবপুর পৌরসভায় উন্নীত হওয়ার পর থেকে একটানা আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। এবারই প্রথম হাতছাড়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, মনোনয়ন বাজেয়াপ্ত হয়েছে নৌকার প্রার্থীর। বিএনপির বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছেন নৌকার প্রার্থীর চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বেশি ভোট। বিএনপির দলীয় প্রার্থী হাবিবুর রহমান মানিক ৫ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। মাধবপুরে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিলেন শ্রীদাম দাশগুপ্ত। তিনি নৌকা নিয়ে পেয়েছেন মাত্র ৬০৮ ভোট।
দলের পরিচয়ে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর ভিড়ে খোদ দলীয় প্রার্থী অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলেন নির্বাচনে। ফলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পংকজ কুমার সাহা নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে ৪ হাজার ১৮৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় এবং আওয়ামী লীগেরই অপর বিদ্রোহী প্রার্থী শাহ মো. মুসলিম জগ প্রতীক নিয়ে ৩ হাজার ৮৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। নির্বাচনে পরাজয় ও একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার নেপথ্যে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল ছিল বলে দাবি করেছেন দলের তৃণমূল নেতারা।
অপরদিকে নবীগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে ডুবেছেন গোলাম রসুল চৌধুরী রাহেল। ক্ষোভে শনিবার রাতে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। রাহেল বন ও পরিবেশ মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের জামাতা। রাজনীতিতে অনেকটা নবীন রাহেলকে অনেকেই মেনে নেননি। প্রচারণায় দলের নেতাকর্মীদের জমজমাট উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও ভোটের দিনের চিত্র ছিল ভিন্ন।
নবীগঞ্জ পৌরসভায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বর্তমান মেয়র ছাবির আহমদ চৌধুরী ৫ হাজার ৭৪৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরী পেয়েছেন ৫ হাজার ৪৮৫। স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহবুবুল আলম সুমন জগ প্রতীকে পান ২ হাজার ৬১৯ ভোট।
নির্বাচনে এমন ফল বিপর্যয়ের ব্যাপারে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন যুগান্তরের কাছে। তার মতে, মাধবপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এবারই প্রথম সেখানে পরাজয় হয়েছে আমাদের। দলের আদর্শবিরোধীরা জোট বেঁধে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে প্রার্থী হওয়ায় এই বিপর্যয় ঘটেছে। শায়েস্তাগঞ্জেও তিন বিদ্রোহী ছিল। সংগঠনের অভ্যন্তরের কিছু আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড নবীগঞ্জে আমাদের ডুবিয়েছে। তবে নৌকার ভোট কমেনি, গড়ে সবখানেই বেড়েছে।
তবে হবিগঞ্জে নৌকা ডুবলেও ভেসেছে মৌলভীবাজারে। জেলার কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ পৌরসভায় নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। ভরাডুবি হয়েছে বিএনপি প্রার্থীদের। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও নেই বিএনপি। ফলে নৌকার সাথে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরাই।
কুলাউড়া পৌরসভায় বিজয়ী নৌকার প্রার্থী অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী শাহজাহান মিয়া। তাদের দুজনের ভোটের ব্যবধান মাত্র ১৫২। নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ধানের শীষ প্রার্থী কামাল উদ্দিন আহমদ জুনেদ ১ হাজার ৭৭৬ ভোট। অথচ কুলাউড়া পৌরসভার মোট ভোট ২০ হাজার ৭৫৯। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শফি আলমও সেখানে ২ হাজার ৯৯৪ ভোট পেয়েছেন।
এদিকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ পৌরসভায় নৌকার প্রার্থীর বিজয় হয়েছে। সেখানে প্রথম থেকে তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী সবাই আওয়ামী লীগের। ধারে কাছেই নেই বিএনপি। মাত্র ৩০১ ভোট পেয়ে মনোনয়ন বাজেয়াপ্ত হয়েছে ধানের শীষ প্রার্থীর।
নৌকা প্রতীক নিয়ে ৫ হাজার ২৫৭ ভোট পেয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন জুয়েল আহমদ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হেলাল মিয়া পেয়েছেন ২ হাজার ৮০৬ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী অপর বিদ্রোহী আনোয়ার হোসেনও পেয়েছেন ২ হাজার ৭৮৭ ভোট। অথচ বিএনপির প্রার্থী আবুল হোসেন পেয়েছেন মাত্র ৩০১ ভোট। ওই পৌরসভায় মোট ভোটার ১৩ হাজার ৯০০ জন। এর মধ্যে ভোট গ্রহণ হয়েছে ১১ হাজার ১৫১টি।
তবে ভোটের হিসাবে বিশাল ব্যবধান থাকলেও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান দাবি করছেন, কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ পৌরসভায় সুষ্ঠু ভোট না হওয়ায় বিএনপির প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। দেশে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নেই বলেই এ অবস্থা।
সুনামগঞ্জের তিনটি পৌরসভা নির্বাচনে দুটিতে আওয়ামী লীগ এবং একটিতে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ পৌরসভায় পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নাদের বখত। তিনি ভোট পেয়েছেন ২১ হাজার ৬৬৯। তার তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মুর্শেদ আলম পেয়েছেন ৫ হাজার ৮৮৫ ভোট। তাদের দুজনের ভোটের ব্যবধান ১৬ হাজার।
এমন পরাজয়ের জন্য স্থানীয় বিএনপির নেতৃত্বের দৈন্যতাকেই দায়ী করছেন তৃণমূল। তাদের মতে, প্রার্থী মনোনয়নে ভুল ছিল। পরিচিতদের আড়াল করে তুলনামূলক অপরিচিত মুখকে প্রার্থী করায় এত ভোটের ব্যবধান ঘটেছে।
সুনামগঞ্জে এবারের নির্বাচনে গোষ্ঠীতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা ছিল না। যদিও অতীতে রাজা ও বখত গোষ্ঠীর মধ্যে ছয়বার প্রতিযোগিতা হয়েছে। সেই ভোট যুদ্ধে প্রার্থীরা পরস্পরকে টপকিয়ে পৌরসভার মসনদের দাবিদার হয়েছিলেন। এবার বখত পরিবারের বিপরীতে বখত পরিবারের প্রার্থী ছিলো না। তাই নাদেরের বিজয় নিরাপদ হয়েছে বলে মনে করেন সুনামগঞ্জের বিশিষ্ঠজন।
জেলার শিল্পশহর খ্যাত ছাতকে চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের আবুল কালাম চৌধুরী। এবারে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী রাশিদা আহমদ ন্যান্সি। বিগত নির্বাচনগুলোর তুলনায় ন্যান্সি ধানের শীষকে অনেক এগিয়ে নিয়ে আসলেও বিজয় হয়েছে নৌকারই। নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ১২ হাজার ৮২৩ ও ধানের শীষে ৭ হাজার ৯০৮ ভোট পড়ে।
প্রবাসী অধ্যুষিত জগন্নাথপুর উপজেলায় বিএনপির বিদ্রোহী আক্তারুজ্জামান আক্তার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান মিজানুর রশিদ ভূঁইয়াকে পরাজিত করেছেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধই এখানে কাল হয়েছে নৌকার। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কুফলের পাশাপাশি প্রার্থী মনোনয়নের ভুল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে এবারের নির্বাচন- এমন আলোচনা জগন্নাথপুরের সর্বত্র।
বিএনপির বিদ্রোহী আক্তারুজ্জামান ৮ হাজার ৩৭৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মিজানুর রশিদ পান ৮ হাজার ১৮ ভোট। অথচ বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হারুনুজ্জামান পেয়েছেন মাত্র ৮১৮ ভোট। সুনামগঞ্জে জামায়াত নির্বাচনে নীরব ছিল।
সুনামগঞ্জের ফলাফল পর্যালোচনা করে জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, প্রার্থী মনোনয়নে কিছুটা ভুল ছিল। জনপ্রিয়দের বাদ দেয়ার কারণেই শাসক দলের প্রার্থী ও বিএনপি প্রার্থীদের ডুবিয়ে বিদ্রোহীরা বিজয়ী হয়েছেন।
তার মতে, দলের অভ্যন্তরে মেয়র-চেয়ারম্যান হোক, এটা খোদ দলের স্থানীয় দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ চান না!
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন