দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আরও তিন বছর। সরকারের গেল দুই বছরে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে অসীমাংসিত বিষয়ে কোনো আলোচনায়ই শুরু হয়নি। সামনের দিনগুলোয় কী হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এমন কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও আগামী নির্বাচন নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি নিয়ে বিএনপিতে আলোচনা শুরু হয়েছে। ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে কারা প্রার্থী হতে পারেন তার একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে। নতুন বছরের শুরুতেই বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার জরিপ করা হবে বলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে। এখনই কেন বিএনপির ভাবনায় ২০২৩ সালের নির্বাচন- এ বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে একান্ত আলাপ হয়। তাদের কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট যে, নির্বাচনের আগে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলনেরও চিন্তা আছে। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকেও বিরত থাকবে না। তাই সামনে বাধা কী আসতে পারে এমন বিষয়গুলো সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। তবে বিএনপি আগামীর রাজনীতি নিয়ে জাতির সামনে তাদের স্পষ্ট একটি বক্তব্য তুলে ধরবে, যা তৈরির কাজ চলছে। একাধিক নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রচ্ছন্ন প্রভাব রাখে এমন দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে নানাভাবে তাদের দলের নেতারা চেষ্টা করে আসছিলেন। পার্শ্ববর্তী একটি দেশের সঙ্গে সেই সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও সামনের নির্বাচনে ওই দেশকে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। কারণ সরকারের সঙ্গে আরও একটি দেশের সম্পর্ক যেভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, তাতে আওয়ামী লীগের পার্শ্ববর্তী মিত্র দেশ রুষ্ট হচ্ছে। যার কারণে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন বিএনপির কূটনীতিক উইংয়ের নেতারা।
এ কারণে বিদেশনীতি কী হবে তা নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা চলছে।
বিএনপি নেতাদের মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এই মুহূর্তে দেশে কোনো গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নেই। এসব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে বিদ্যমান অবস্থায় ‘এককভাবে’ কোনো দাবিই সরকারের কাছ থেকে আদায় করা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় মামলায় মামলায় জর্জরিত বিএনপি সাংগঠনিক ও মানসিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলটি শক্তি সঞ্চয় করতে চাইছে। এ জন্য প্রথমে বিএনপি ও তার ১১ অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি কমিটি গঠন করা হবে। নিজ জোটে ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক সংলাপ করে তাদের মনোভাব যাচাই করে একটি ‘নিরপেক্ষ সরকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি’তে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ শুরু করবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে চাইছে বিএনপি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও দলটির মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও বলে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি দেশে গণতন্ত্র নেই, দেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়। আমরা ছাড়াও দেশে আরও ব্যক্তি, দল সমাজে অনেক লোক আছে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। আমাদের ঐক্য আছে- আমাদের ২০ দল আছে, ঐক্যফ্রন্ট আছে- এটাকে আরও সম্প্রসারণ করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার দাবি সবার, একটি দল তো একা ফাইট করে দাবি আদায় করতে পারে না। সবার মধ্যে একটা ঐক্য সৃষ্টি করেই গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলন সফল করা সম্ভব। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র এই নেতা বলেন, এটা সময়ই বলে দেবে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলকে শক্তিশালী ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করলেই হবে না; এই সরকারের কাছ থেকে যে কোনো দাবি আদায় করতে হলে দেশি-বিদেশি ক্ষমতা পরিবর্তনের যে ‘পাওয়ার হাউস’ তাদের মনোভাবও বুঝতে হবে। এসব ‘পাওয়ার হাউস’ সংশ্লিষ্টরা কী চায় তাও বুঝতে হবে। তার আগে দলের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর বিষয়ে বিএনপির কী অবস্থান তাও স্পষ্ট করতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে ভারত ও চীনকে হ্যান্ডেল করছে- এই অবস্থায় মাঝামাঝি থেকে দেশি-বিদেশি কোনো পক্ষকেই পাশে পাবে না বিএনপি। সেদিক নিয়েও চিন্তা করছে দলটি। এই অবস্থায় জামায়াতকে জোটে রাখা, না রাখা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তবে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে জোটে না রেখে দলটির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি করার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। যদিও দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপির কোনো নেতাকে এই মুহূর্তে জামায়াত আস্থায় নিতে পারছে না।
ওই নেতা আরও বলেন, ‘পাওয়ার হাউস’র মনোভাব বুঝতে হবে। সেই অনুযায়ী দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বক্তব্য ও দাবি তুলতে হবে। যে দাবিতে দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো পক্ষে দাঁড়ায়। তাহলেই সরকার দাবি মানতে বাধ্য হবে।
সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা মতামত তুলে ধরেন বলে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে বৈঠকে নেতারা বলেন, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির আগে নিজ দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার প্রতি আরও জোর দিতে হবে। বিএনপি ও তার ১১ অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের প্রতিটি ইউনিট কমিটি গঠনের পর নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে বুঝতে হবে। এরপর জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির কাজ করতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আমাদের সময়কে বলেন, আমরা প্রথমে নিজ দলকে সংগঠিত করব।
দলটির নেতারা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা প্রায় এক যুগ ধরে ক্ষমতায়। এই সময়ে দেশের মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র হরণ হয়েছে। সুশাসন বলতে কিছুই নেই। এটা প্রমাণিত, এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোরও কোনো ক্ষমতাও বিএনপির নেই। সেক্ষেত্রে কোনো সুযোগ না থাকলে তারা কাজে লাগাবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, আজকে কোর্ট-কাচারি-উচ্চ আদালত থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে, এক ব্যক্তির কথায় চলে। শুধু একটা সুযোগ, একটা পরিবেশের অপেক্ষায় আছি। একটি গণজাগরণের মধ্য দিয়ে এই সরকারকে বিদায় করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আমরা বদ্ধপরিকর।
দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, রাজপথে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে সব সময় আন্দোলনমুখী করতে হবে। পাশাপাশি ২০২৩ সালে দ্বাদশ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে সেদিকে না তাকিয়ে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাহলে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় যে কোনো কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন