‘৭৮/১ মৌলভীবাজারের ভাঙার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য চকবাজার মডেল থানা আমাদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছে, যার কারণে নিশ্চিন্তে এবং নির্বিঘ্নে শামীম স্টোরের দখলে থাকা বিল্ডিংটি ভাঙা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং উক্ত কাজে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য চকবাজার থানার ওসি মহোদয়কে উপহার স্বরূপ...।’ নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের ডায়েরিতে এভাবেই কর্মকর্তাদের বখরা দেওয়ার তথ্য মিলেছে। মাত্র ৪ দিন আগের (গত শনিবার) ঘটনাটি ওই দিনই ডায়েরিতে লেখেন ইরফান সেলিম। পুলিশ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের এভাবে ‘উপঢৌকন’ দিতেন তিনি। অভিযান পরিচালনাকারী বাহিনী সূত্রে ডায়েরির এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেছে র্যাব। গতকাল দুপুরে র্যাব সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, চাঁদাবাজি দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের কাজে ওয়াকিটকি ব্যবহার করা হতো। ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করত তারা। এ ঘটনায় র্যাব বাদী হয়ে আরও দুটি মামলা করেছে। ইরফান সেলিমের চাঁদাবাজির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইরফান সেলিম কানাডায় পড়ালেখা করেছেন। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে এর আগে কাউন্সিলর ছিলেন সাংসদ হাজী সেলিমের ভাগ্নে। বিভিন্ন বিষয় ভাগ্নের সঙ্গে টানাপড়েন দেখা দিলে ছেলে ইরফানকে কানাডা থেকে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে প্রবেশ করান সাংসদ। আর হাতেখড়ি হয় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে। বাংলা ঠিকমতো না জানা ইরফান ইংরেজিতে কথা বলেন বেশিরভাগ সময়। মাতৃভাষা ঠিকমতো না জানলেও বাবার আশীর্বাদে ইরফান অতি সহজেই কাউন্সিলর হয়ে যান।
সূত্র জানায়, রবিবার রাতে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের সময় মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন ইরফান। অভিযানের পর গত সোমববার রাতে ডোপ টেস্ট করে বিষয়টি নিশ্চিত হন অভিযান সংশ্লিষ্টরা। তার দেহরক্ষী জাহিদুল ইসলাম ঘটনার দিনও ইয়াবা সেবন করেছিলেন। ইরফান সেলিমের ৩০ জনের বেশি নিজস্ব ক্যাডার রয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন সব সময় তার সঙ্গে থাকতেন। সুঠাম দেহের অধিকারী এসব ক্যাডারের বেশিরভাগই একটি বিশেষ জেলার বাসিন্দা দেখে নিয়োগ দেওয়া হতো।
তদন্ত সূত্র জানায়, বেইজ স্টেশন ও ৩৮টি ওয়াকিটকি দিয়ে পুরান ঢাকার ১০ কিলোমিটার এলাকায় নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন ইরফান। মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতেই এ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন তিনি। কাউকে প্রয়োজন মনে করলে তুলে আনার নির্দেশ দিতেন এই যোগাযোগ চ্যানেলে। পরে তাকে নিজের ‘টর্চার সেলে’ নিয়ে নির্যাতন চালানো হতো। বেইজ স্টেশন ও ওয়াকিটকি বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে আনেন ইরফান সেলিম।
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর ও হত্যাচেষ্টা মামলায় ইরফান এবং তার বডিগার্ড জাহিদুল ইসলামের সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (নিরস্ত্র) আশফাক রাজীব হায়দার মামলাটিতে আসামিদের গ্রেপ্তার দেখানোসহ এ রিমান্ড আবেদন আদালতে পাঠান। ধানমন্ডি থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা মো. আশ্রাফ জানান, সিএমএম আদালতে বুধবার ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূর আসামিদের উপস্থিতিতে শুনানি গ্রহণ করবেন।
এদিকে ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী এবি সিদ্দিকী দিপুর একই মামলায় গতকাল ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদার এ রিমান্ডের আদেশ দেন। ধানমন্ডি থানা পুলিশ আসামি দিপুকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। গত সোমবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে টাঙ্গাইল থেকে দিপুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত রবিবার নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ খান স্ত্রীকে নিয়ে রাত পৌনে ৮টার দিকে মোটরসাইকেলে করে কলাবাগানের দিকে যাচ্ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো একটি কালো রঙের ল্যান্ড রোভার (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬) পেছন থেকে তাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এর পর তিনি সড়কের পাশে মোটরসাইকেলটি থামিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ান এবং নিজের পরিচয় দেন। তখন গাড়ি থেকে নেমে ইরফান সেলিম এবং তার সঙ্গে থাকা অন্যরা তাকে কিল-ঘুষি মারেন এবং মেরে ফেলার হুমকি দেন। তার স্ত্রীকে গালিগালাজ করেন।
এ ঘটনায় পরদিন সকালে ইরফান সেলিম, তার বডিগার্ড জাহিদ, দিপু এবং গাড়িচালক মিজানুর রহমানসহ অজ্ঞাত ২-৩ জনকে আসামি করে ওয়াসিফ আহমদ ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন। ওই দিনই হাজী সেলিমের গাড়িচালক মিজানের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন