মুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেল পুরান ঢাকার পরিচিত ও আলোচিত সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের সাজানো সংসার। ছেলের কুকর্ম ও তুচ্ছ ভুলের কারণে তার এই দশা। নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর করার ঘটনার মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
রোববার রাতে রাজধানীর কলাবাগানে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খানের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেন পুরান ঢাকার সরকার দলীয় সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের পুত্র ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিমকে বহনকারী গাড়ি। এটিতে ‘সংসদ সদস্য’ লেখা স্টিকার লাগানো ছিল। কারণ জানতে চাইলে ওই নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে উল্টো মারধর করেন ইরফান ও তার সহযোগীরা।
এ ঘটনার পর সোমবার সকালে ধানমণ্ডি থানায় মামলা হয়। এরপর দুপুরে থেকে সন্ধ্যা পুরান ঢাকার চকবাজার থানাধীন দেবদাস ঘাট লেন হাজী সেলিমের পৈত্রিক বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। সেখানে অবৈধ মাদক, ৩৮টি ওয়াকিটকি, অস্ত্র, গুলি ও হ্যান্ডকাপসহ অনেক মালামাল পায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। গতকাল সন্ধ্যায় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ রাজধানীর চকবাজারে হাজী সেলিমের বাসার নিচে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি জানান, পুরান ঢাকার ‘সাম্রাজ্য চালাতে’ হাজী সেলিমের বাসায় কন্ট্রোল রুম গড়ে তোলা হয়েছিল।
আশিক বিল্লাহ জানান, অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে ছয় মাস এবং মাদক রাখা ও সেবনের দায়ে ছয় মাস করে মোট এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেনে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। এ ছাড়া তার কক্ষ থেকে লাইসেন্সবিহীন বিদেশি অস্ত্র, একটি একনলা বন্দুক, একটি ব্রিফকেস, মদ ও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু অবৈধ জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দেহরক্ষী মো. জাহিদের কাছ থেকে ৪০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের ৩৮ থেকে ৪০টি ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। আশিক বিল্লাহ বলেন, এ ছাড়া আমরা তাদের কাছ থেকে গুলি, হ্যান্ডকাফ, একটি ড্রোন এবং কন্ট্রোলরুম থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি ভেরি হাইসিকিউরিটি সেট (ভিএইচএস) উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। এটা ওয়াকিটকির একটি আধুনিক সংস্করণ। এ ছাড়া ওই বাসায় টর্চার শেলের সন্ধান পাওয়া গেছে।
অভিযানকালে ওই বাড়িটিকে ঘিরে শত শত মানুষ জড়ো হয় চকবাজার এলাকায়। আটতলা বিশিষ্ট বাড়িতে হাজী সেলিম নিজে এবং তার ছেলেরা থাকেন। হাজী সেলিমের তিন ছেলে। তার মেজ ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম থাকেন পঞ্চম তলায়। চতুর্থ তলায় থাকেন ইরফান সেলিমের স্ত্রী, বাড়ির দ্বিতীয় তলায় হাজী সেলিম এবং ষষ্ঠ তলায় থাকেন বড় ছেলে সুলাইমান সেলিম। ছোট ছেলে আশিক সেলিম অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা করেন। বাকি তলাগুলো ভাড়া দেয়া রয়েছে।
‘সাম্রাজ্য চালাতে’ বাসায় যেন কট্রোলরুম : পুরান ঢাকা এলাকা ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করতে হাজী সেলিমের বাসায় গমড় তোলা হয়েছে আধুনিক রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিসহ অত্যাধুনিক কট্রোল রুম। কন্ট্রোল রুমে রয়েছে আধুনিক ভিপিএস (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার), ৩৭টি ওয়াকিটকি, ড্রোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) নিরাপত্তায় নিয়োজিত এলিট বাহিনীর কাছে যেসব সরঞ্জাম থাকে, সে রকম সরঞ্জাম পাওয়া গেছে এখানে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষায় এই কন্ট্রোল রুম ব্যবহার করা হতো বলে র্যাবের ধারণা। বিদেশি অস্ত্র, হ্যান্ডকাফ ও মদও জব্দ করেছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
‘কন্ট্রোল রুমের’ বিষয়ে র্যাবের কর্মকর্তারা বলেন, হাজী সেলিমের আটতলা ভবনের তিন ও চার তলা থেকে এসব সরঞ্জামসহ তারা অবৈধ একটি বিদেশি পিস্তল ও একনলা বন্দুক জব্দ করেছেন। কালো ৩৭টি ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ওয়াকিটকির প্রতিটি চার কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা কাভার করত। এ ধরনের ওয়াকিটকি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়া ব্যবহার করা নিষেধ।
গাড়িচালক মিজানুর রিমান্ডে : সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফানের গাড়িচালক মিজানুর রহমানকে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান মো. নোমান এ অনুমতি দেন। পুলিশ আসামি মিজানুর রহমানকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে তাকে একদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন।
হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম রবিবার রাতে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদের ওপর হামলা মামলার প্রধান আসামি। ইরফানের দেহরক্ষী মো. জাহিদ মামলার ৩ নম্বর আসামি। ওই মামলার আসামি হাজী সেলিমের গাড়িচালক মিজানুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে এক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এর আগে ইরফান সেলিমসহ সাতজনের বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থানায় হত্যা চেষ্টার মামলা কমরন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ধানমণ্ডি থানার ওসি মো. ইকরাম আলী মিয়া জানান, রোববার রাতের ঘটনায় গতকাল সকালে একটি মামলা হয়েছে। মামলা নম্বর ১৬। এ মামলার বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে ওয়াসিফ আহমদকে রক্তাক্ত দেখা যায়। ভিডিওতে তাকে মারধর করে তার দাঁত ভেঙে ফেলা হয়েছে বলেও দাবি করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন