শাসক পরিবার ও আওয়ামী স্বার্থরক্ষায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নির্লজ্জ বিচার বিভাগ। সভ্য দেশে শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার নিপীড়ন থেকে রেহাই পেতে মানুষকে সুরক্ষা দেয় বিচার বিভাগ। আর বাংলাদেশে ঘটছে ঠিক উল্টা। জনগণের সুরক্ষা নয়, আওয়ামী শাসক গোষ্ঠী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বার্থরক্ষাই যেন বিচার বিভাগের দায়িত্ব। বিচার বিভাগের এই দায়িত্ব পালনের সর্বশেষ নজির হচ্ছে, মধ্যরাতের ভোট ডাকাতির সংসদের সদস্য শাসক পরিবারের আত্মীয় নিক্সন চৌধুরীকে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ জামিন বহাল রাখলেন। একজন মহিলা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ফোনে গালিগালাজ ও দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় এসেছিলেন নিক্সন চৌধুরী। টেলিফোনে তাঁর এই হুমকি ও গালি গালাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সিভিল সার্ভিস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নিয়ম রক্ষার বিচারের দাবী উঠেছিল। এতে নির্বাচন কমিশনও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেছিল নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে। কিন্তু মামলা হলে কি হবে। বিচার বিভাগ তো নিক্সন চৌধুরীদের পকেটে।
ঘটনাটি ছিল ফরিদপুরে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি উপজেলার উপ-নির্বচনে ভোট গ্রহনের দিনে ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে। তাঁর সমর্থক কর্মীরা উপজেলা নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে অনিয়ম করতে গেলে সেখানে কর্তব্যরত ম্যাজিষ্ট্রেট বাঁধা দেয়। এক পর্যায়ে ওই কর্মীকে আঁটক করার চেষ্টা করেন ম্যাজিষ্ট্রেট। এই খবর তাঁর কানে পৌছা মাত্রই তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ফোন দেন। কেন তাঁর কর্মীকে আটক করা হল এই নিয়ে মহিলা ইউএনওকে গালিগালাজ করেন। ম্যাজিষ্ট্রেটকে শুয়রের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা সম্বোধন করে মহিলা ইউএনওকে দেখে নেয়ার হুমকি নেন।
এই টেলিকথোপকথন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়লে সিভিল সার্ভিস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নিয়ম রক্ষার প্রতিবাদ করা হয়। নির্বাচন কমিশন প্রথমে তদন্ত করে বিষয়টি। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়ার ঘোষণা দিয়ে নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়ের করে নির্বাচন কমিশন।
এই মামলায় নিক্সন চৌধুরী হাইকোর্টে গেলে ৮ সপ্তাহের জামিন পায়। এ জামিনের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন লিভ টু আপিল করে। আজ (২২ অক্টোবর) এই লিভ টু আপিলের শুনানী হয় আপিল বিভাগের চেম্বার জজ নুরুজ্জামানের আদালতে। আপিল বিভাগের ‘চেম্বার জজ মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ এই পরিচিত পায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই। নিক্সন চৌধুরীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। চেম্বার জজ আদালত শাসক পরিবারের স্বার্থই রক্ষা করলেন এ ক্ষেত্রে। চেম্বার জজ নুরুজ্জামান হাইকোর্টে দেয়া নিক্সন চৌধুরীর জামিনের বিরুদ্ধে কোন আদেশ না দিয়ে সেটা বহাল রাখলেন সুকৌশলে। শাসক পরিবার ও আওয়ামী লীগে স্বার্থ রক্ষায় যত রকমের কৌশল রয়েছে সবই তারা প্রয়োগ করেন। একদিকে আওয়ামী লীগ ও শাসক পরিবারের সদস্যদের সুযোগ দিতে কৌশল প্রয়োগ করেন উচ্চ আদালতের বিচারকরা। অপর দিকে বিরোধী জোটের নেতা-নেত্রীদের বেকায়দায় ফেলতে সব রকমের অপকৌশলের আশ্রয় নেয় উচ্চ আদালতের এই বিচারকরাই।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে একই অভিযোগে সারা দেশে অনেক গুলো মামলা দায়ের হয়। এই মামলায় তিনি হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চে গিয়েছিলেন জামিন চাইতে। জামিন দেওয়া তো দূরের কথা, ওই বেঞ্চের বিচারকদ্বয় পরিস্কার ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, ‘আপনাকে আমরা পছন্দ করি না। আপনি জামিন চাইতে আর আমাদের কাছে আসবেন না’। একজন সিনিয়র নাগরিককে জামিন চাইতে না যাওয়ার জন্য হাইকোর্ট সরাসরি বলে দিলেন। কারন তিনি সরকারের দুর্নীতি, দু:শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং লিখেন। তাই উচ্চ আদালতের তথাকথিত বিচারকরা তাঁকে অপছন্দ করেন, এটা জানিয়ে দিলেন প্রকাশ্য আদালতে বসেই।
শুধু আমার দেশ সম্পাদক নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া একজন বয়োবৃদ্ধা এবং অসুস্থ নারী হওয়া সত্ত্বেও এই হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ জামিন মঞ্জুর করেনি। অথচ একই বয়সের কারণে এবং মহিলা হওয়ায় সরকার নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয় তাঁকে। অথচ, অসুস্থতা এবং নারী ও বয়স্কদের জন্য জামিনের অগ্রাধিকারের বিষয়টি সুপ্রিমকোর্টের নানা রায়ের মাধ্যমে স্বীকৃত এবং রেওয়াজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারন তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী।
এদিকে, নিক্সন চৌধুরীকে হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগ উভয় বিভাগে যখন জামিন মঞ্জুর করা হয়, ঠিক একই সময়ে খ্যাতিমান সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজিকে একটি পত্রিকা অফিস থেকে ধরে নিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। রুহুল আমিন গাজিকে তাঁর কর্মস্থল দৈনিক সংগ্রাম অফিস থেকে ধরে নিয়ে যায় থানা পুলিশ। গত বছরের ডিসেম্বরে দৈনিক সংগ্রাম অফিসে হামলা চালায় শাসক দলের অনুগত গুন্ডবাহিনী। ভাংচুর করা হয় পত্রিকা অফিস। উল্টা মামলা দিয়ে দৈনিক সংগ্রামের বয়োজ্যষ্ঠ সম্পাদককে কারাগারে নেয়া হয়। গত মাসে প্রবীন সম্পাদক আবুল আসাদের জামিন মঞ্জুর করেছিল হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ। এই একই চেম্বারজজ নুরুজ্জমান হাইকোর্টের জামিন স্থগিত করে দিয়েছিল পরের দিনই। আবুল আসাদ সাহেবের বয়স ৮০ বছর। তিনি নানা রকম বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ এবং সরকারি গুন্ডা বাহিনীর দায়ের করা মামলায় দীর্ঘ এক বছর ধরে জেলে বন্দি আছেন। বাংলাদেশে আইনের শাসন, ন্যায়, নৈতিকতা সবকিছু লোপ পেলেও মাঝে মধ্যে দেখা যায়, ফ্যাসিবাদি সরকারের মুরব্বি সাম্রাজ্যবাদি রাষ্ট্রের কুটনীতিকরা শেখ হাসিনাকে (চ্যাম্পিয়ান অব রুল অব ‘ল’এবং চ্যাম্পিয়ান অব হিউম্যান সিকিউরিটি) ইত্যাকার নামে অবিহিত করে বাংলাদেশের জনগণের সাথে নিষ্ঠুর তামাসা করেণ। একই মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছিলেন রুহুল আমিন গাজি। জামিনে থাকা মামলায় তাঁকে বুধবার গ্রেফতার করা হয় সংগ্রাম অফিস থেকে। আজ জামিন না দিয়ে পাঠানো হয় কারাগারে। আর একই দিনে নিক্সন চৌধুরী হাইকোর্ট বিভাগের জামিনের পর আপিল বিভাগ সেটা বহাল রেখে জামিনকে আরো প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে।
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালায়ের এই আচরণ নির্লজ্জতাকেও হার মানায়। এই নির্লজ্জ আচরণের মাধ্যমে আইন ও জনমতকে পদদলিত করে সুপ্রিমকোর্ট আওয়ামী শাসক গোষ্ঠী ও তাদের পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন