কার নেতৃত্বে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি, আগেভাগেই এমন আলোচনা শুরু হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। তাঁদের মতে, নেতৃত্বহীন এবং দিকনির্দেশনাহীন অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিলে ফল একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতোই হবে। নেপথ্যে এবং দলের সাংগঠনিক নেতৃত্ব তারেক রহমানের হাতে থাকলেও নির্বাচনকালে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের যেকোনো একজনের সমন্বয়কের ভূমিকায় থাকা উচিত। কোনো কোনো নেতার মতে, তারেক রহমানের মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমানকে এ বিষয়ে সামনে আনলে ভালো হয়।
বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পরামর্শক হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, এক্স-ওয়াই-জেড—বিএনপির যেকোনো একজন শীর্ষ নেতাকে সামনে এনে নির্বাচনকালে নেতৃত্ব দিতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় জাইমা রহমানকে নেতৃত্বের সামনের সারিতে নিয়ে এলে। তা না হলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ প্রশ্নের জবাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘বিএনপি নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। তা ছাড়া জাইমা এলে জনগণের সহানুভূতি বিএনপি পাবে। সরকারও ঘাবড়ে যাবে। তাই এই পরামর্শ তো আমি আগেই দিয়ে রেখেছি।’
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলীয় ফোরামে আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হলেও ভেতরে এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নির্বাচনকালীন নেতৃত্বের বিষয়টি বেশ কিছুদিন যাবৎ আলোচনায় আছে। তবে কৌশলগত কারণে স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে কেউ কথা বলতে চাইছেন না। কারণ নির্বাচনকালীন নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনার অর্থই হলো—খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে একজন নেতাকে সামনে নিয়ে আসা। আর এ ধরনের আলোচনা শীর্ষ দুই নেতার পছন্দ হবে না বলেই সবাই মনে করছেন।
যদিও দলটির ভেতরে ও বাইরে এটিও সবাই ধরে নিয়েছেন যে, আইন ও স্বাস্থ্যগত দুই কারণেই খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। একইভাবে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন না করা পর্যন্ত তারেক রহমানও লন্ডন থেকে দেশে ফিরতে পারছেন না বলে মনে করা হয়।
অবশ্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, এ বিষয়ে আলোচনার সময় এখনো আসেনি। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি চলছে। তাঁরাই দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তবে নির্বাচনের সময় সমন্বয়ের কোনো বিষয় থাকলে সেটি সময় বলে দেবে কী করতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন নেতৃত্ব প্রশ্নে এখনো আলোচনা হয়নি। অবস্থা বুঝে তখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার অবশ্য মনে করেন, ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিএনপির প্রবীণ একজন নেতা আগামী নির্বাচনের আগে সামনে চলে আসবেন।’ কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) সরকার নেতৃত্ব দিতে দেবে না। আর আমরা ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত তারেক রহমান সাহেবও দেশে ফিরতে পারবেন না। ফলে কাউকে না কাউকে নির্বাচনপ্রক্রিয়া সমন্বয় করতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে এই সাবেক স্পিকার বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনকে নেতা বানানো ঠিক হয়নি। তিনি নির্বাচন না করায় বিএনপির ক্ষতি হয়েছে। ফলে এবার বিএনপিরই একজনকে সামনে আনতে হবে। তা না হলে ফল আগের মতোই হবে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান অবশ্য দাবি করেন, ‘গত নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফ্যাক্ট হলো—মূল নেতৃত্বে বিএনপিই ছিল।’ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্ব তো আছেই। নতুন নেতৃত্বের প্রশ্ন উঠছে কেন?’ কিন্তু তাঁদের দুজনের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম—এমন বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে একটি শূন্য আসনে তাঁদের জিতিয়ে আনা খুব কঠিন কাজ নয়।’
২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন চলাকালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে এবং তারেক রহমান লন্ডনে ছিলেন। তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। অন্যদিকে ওই বছর গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ‘শীর্ষ নেতা’ হিসেবে ড. কামাল হোসেনকে সামনে আনা হলেও শেষ পর্যন্ত তিনিও নির্বাচনে অংশ নেননি। এমন পরিস্থিতিতে মনোনয়নের মূল কেন্দ্রে বিএনপি অবস্থান করলেও একরকম নেতৃত্বহীন অবস্থায় অংশ নেয় ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর এক বৈঠকে ঐক্যফ্রন্ট জয়লাভ করলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন সে বিষয়ে কূটনীতিকরা জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে ফ্রন্টের অন্যতম নেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই প্রধানমন্ত্রী ঠিক করবেন। ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচন না করায় ড. কামাল হোসেনের ওপর বিএনপি ক্ষুব্ধ হয় বলে জানা যায়। তা ছাড়া বয়োবৃদ্ধ ড. কামাল আগামী নির্বাচনে আর অংশ নিতে পারবেন বলেও কেউ কেউ মনে করেন না।
অনেকের মতে, ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনকালে নেতৃত্বহীন ওই পরিস্থিতি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তির কাছে বিএনপিকে আস্থার সংকটে ফেলে। তা ছাড়া বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অংশগ্রহণে বড় ধরনের প্রচারাভিযান ছাড়াই ওই পরিস্থিতিতে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়েছে। অথচ ১৯৯১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে প্রচারাভিযান হয়েছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। উপরন্তু নির্বাচনের কয়েক দিন আগে বিএনপি শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা ঢাকা ছেড়ে নির্বাচনী এলাকায় চলে যান। ফলে ওই সময় ঢাকার কূটনীতিকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বিএনপি চাপে ফেলতে পারেনি বলে অনেকে মনে করেন। তা ছাড়া নেতাকর্মীদের পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও আশার সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয় বিএনপির নেতৃত্বহীন ওই নির্বাচন। নির্বাচনকালীন নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপিতে আগাম আলোচনা এসব কারণেই শুরু হয়েছে বলে জানা যায়।
দলটি শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, নির্বাচনকালীন নেতা নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি অনেক আগেই নিষ্পত্তি করতে হবে। তাঁদের মতে, এটি এমন একটি ইস্যু যা তফসিল ঘোষণার পর বা নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় না। তাঁদের মতে, বিষয়টি নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু করা দরকার। যদিও ওই প্রশ্নে আলোচনা কে তুলবে তা নিয়ে দলটির নেতাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। কারণ এমন আলোচনা খালেদা ও তারেক ভালোভাবে না-ও নিতে পারেন বলে তাঁদের ধারণা।
গত দুই সপ্তাহ ধরে কথা বলে এ বিষয়ে বিএনপির মধ্যে দুই ধরনের মতামত পাওয়া গেছে। কিছু নেতা বিশ্বাসই করতে চান না যে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান নতুন কাউকে দায়িত্ব দেবেন। তাঁদের মতে, অন্য কাউকে তাঁরা দায়িত্ব দেবেন বলে মনে হয় না। আবার কারো মতে, পরিস্থিতির কারণেই হয়তো শেষ পর্যন্ত তাঁরা কাউকে না কাউকে সামনে আনতে বাধ্য হবেন। তবে অবশ্যই তা খালেদা ও তারেকের বিশ্বস্ত একজনকে।
তবে কালের কণ্ঠকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির কেন্দ্রীয় একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘একজনকে ডেকে বলে দিল আর তাতেই হয়ে গেল বিষয়টি এমন নয়।’ তাঁর মতে, ‘নেতৃত্ব একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হলেই ভালো হয়। তা না হলে কেউ মানবে না। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে ভোটাভুটি হতে পারে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন