‘ভুলের খেসারত’ মানতে নারাজ দলটির নেতারা
ভুল নয়, জামায়াতের ভূমিকা সব সময়ই দেশ, দেশের মানুষের কল্যাণ, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিল-সেক্রেটারি জেনারেল
বিচারে অংশ নেয়ার বিষয়টি ছিল সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত, ব্যক্তিগতভাবে মনে করি অংশ নেয়ায় সাকসেসফুল হয়েছি-ব্যারিষ্টার আবদুর রাজ্জাক
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের নির্যাতন ও নিপীড়নে দৃশ্যমান ক্ষয়িষ্ণু জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে দেখা যায় না দীর্ঘ দিন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতারোহণের পর প্রতিপক্ষ দমন শুরু হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীকে দিয়ে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দিয়ে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখার মাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ দমনের মিশন অনেকটাই পূর্ণতা পায়। অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও রাজপথ থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া নির্যাতন ও নিপীড়নের চাপে জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত কার্যালয় গুলো গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। দলটির সিনিয়র নেতাদের ফাঁসি ও অনেক নেতাকর্মী গুম, ক্রসফায়ার ও খুনের মাধ্যমে রাজপথ থেকে জামায়াতে ইসলামীকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে নিপীড়ন ছাড়াও অতীতের ভুল রাজনীতির খেসারত হিসাবেই দলটির এমন ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা।
জামায়াতে ইসলামীর নীতি নির্ধারক নেতারা অবশ্য দলটির বর্তমান পরিস্থিতির সাথে ক্ষয়িষ্ণু শব্দটি মানতে নারাজ। অতীতে ভুল রাজনীতির কথাটিও দলটির বর্তমান সিনিয়র নেতৃত্ব মানতে রাজি নন। তাদের মতে জামায়াতে ইসলামী পূর্ণ সাংগঠনিক শক্তি নিয়েই রাজনীতিতে আছে। যদিও কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দিন কাটে আদালত পাড়া আর জেল খানায় আসা-যাওয়ার মধ্যে।
দলটির সিনিয়র নেতাদের মতে সরকারের নির্যাতন আর নিপীড়নের ফলে কৌশলগত কারণে মাঠের রাজনীতি থেকে নীরবতা অবলম্বন করলেও সাংগঠনিক কার্যক্রমে কোন ভাটা পড়েনি। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও দলের কাউন্সিল থেকে শুরু করে সবই গঠনতন্ত্র মাফিক চলছে বলে দাবী সিনিয়র নেতাদের। ক্ষয়িষ্ণু মানতে রাজি না হওয়ার পেছনে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ২০১৪ সালে চরম প্রতিকূলতার মাঝেও দলটি উপজেলা নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিল। এমন উদাহরণ দিয়ে দলটির সিনিয়র নেতারা বলেন, জনগণকে সঠিকভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিতে পারলে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে নির্বাচনী মাঠে ভাল ফলাফল করবে দলটি। তবে দলটি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হচ্ছে একেবারেই নেতাদের দাবীর বিপরীত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে অতীত রাজনীতির ভুলের খেসারতে ক্ষয়িষ্ণু জামায়াত
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে এক দলীয় বাকশাল গঠনের মাধ্যমে শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসন থেকে বাংলাদেশের জনগণকে মুক্তি দিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেন। সেই সুযোগ গ্রহণ করে শেখ মুজিব প্রশাসন দ্বারা নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মলাভ করে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একই সময় একই প্রক্রিয়ায় বাকশালে বিলীন হওয়া আওয়ামী লীগেরও পুনর্জন্ম ঘটে জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলাম প্রথম ভুল করে স্বৈরাচার এরশাদের দোসর আওয়ামী লীগের সাথে মিলে স্বৈরশাসনের অধীনে ১৯৮৬ সালে পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। দ্বিতীয় ভুলটি হচ্ছে, সেই আওয়ামী লীগ এবং এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথেই গাঁটছড়া বেঁধে ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ। জামায়াতের ভুলের সুযোগ নিয়ে জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাজনীতি থেকে প্রায় বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে আওয়ামী নেত্রী ও শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা শুধু পুনর্বাসিতই হননি, ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনও লাভ করেন।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ভারত নিয়ন্ত্রিত এবং পূর্ব হতেই ফলাফল নির্ধারিত নির্বাচনে অনেকটা চাপ প্রয়োগ করে বিএনপিকে ভোটে টেনে নিয়ে জামায়াত তাদের তৃতীয় ভুলটি করে বলে মনে করা হয়। আর এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পথটি সুগম করে দেয় তারা। এর চার বছরের মাথায় দলটি যে বৃহত্তর ভুলের ফাঁদে পা দেয় সেটি রাজনৈতিকভাবে আত্মহত্যার সমতুল্য বলেও মনে করেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্র আমার দেশ এবং লন্ডনের সাপ্তাহিকী দি ইকোনমিস্ট প্রায় একই সংগে চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের তখন ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছিলো। অনুসন্ধানী রিপোর্টে প্রমাণ মেলে যে সাজানো মামলায় বিচারের রায় আগে থেকেই সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে আছে। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশের প্রেক্ষাপটে অন্য যে কোন রাজনৈতিক দলের সেই ক্যাঙ্গারু কোর্ট বর্জনের কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে অবাক করে জামায়াতে ইসলাম সেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ট্রাইব্যুনালেই ফিরে গিয়ে দলটির ভাষায় তাদেরই শীর্ষ নেতাদের ‘জুডিশিয়াল মার্ডারকে’ বৈধতা দেয়। এই পর্বতসম ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে জামায়াতে ইসলাম আদৌ বাংলাদেশের মাঠের রাজনীতিতে অতীতের ন্যায় আর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারবে কিনা সেটা অনেকের কাছে শত কোটি টাকার প্রশ্ন।
২০১৮ সালের সাজানো নির্বাচনের পর ২০২০ সালের শেষ লগ্নে ফ্যাসিবাদ কবলিত বাংলাদেশে মাঠের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন। দলটির নেতারা রাজনীতি করছেন নাকি সমাজ সেবা করছেন এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে। তাছাড়া দলটির নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে বিএনপির লেজুড়বৃত্তি করার কৌশলের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে যা বললেন, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল:
উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ গোলাম পরোয়ার ও জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ডিফেন্স টিমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সাথে। ব্যারিষ্টার আবদুর রাজ্জাকের সাথে মূলথ ট্রাইব্যুনালের প্রসঙ্গটি নিয়েই আলোচনা হয়।
সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রসঙ্গে বলেন, এই সিদ্ধান্ত তৎকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সঠিক ছিল। তখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ১৫ দল, ৭ দল ও জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছিল। সকল দলের সিদ্ধান্ত ছিল নির্বাচনে না যাওয়া। হঠাৎ করেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। জামায়াতে ইসলামীও তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসাবেই নির্বাচনে অংশ নেয়। জামায়াতে ইসলামী দেশের কল্যাণ ও জাতীয় প্রয়োজনকে সামনে রেখে সাংবিধানিক পন্থায় রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে। জামায়াতে ইসলামী তখন নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১০ আসন লাভ করে। তিনি বলেন, এটাও অনস্বীকার্য স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতেই ১৯৮৮ সালে জামায়াতে ইসলামীর ১০ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। এই পদত্যাগের ফলেই এরশাদ সংসদ ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয়। এর ধারাবাহিকতায়ই ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতন ঘটে।
মিয়া গোলাম পরোয়ারের অভিমত অনুযায়ী ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সাথে মিলে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেও জামায়াতে ইসলামী ভুল রাজনীতি মনে করে না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই প্রস্তাবটি প্রথমে জামায়াতে ইসলামী দিয়েছিল। যেটি ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারীর নির্বাচন পরবর্তীতে সারা দুনিয়া জুড়ে প্রশংসা লাভ করে। মানুষও ভোট দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে তখন। এর প্রেক্ষিতেই তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তখন নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সরকার এ দাবী না মানায় জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবীতে আন্দোলনে নামে। একই দাবীতে তখন আওয়ামী লীগও আন্দোলন শুরু করে। জামায়াতে ইসলামীর দাবীর সাথে একমত হয়ে অন্য কোন দল আন্দোলন করলে তো দোষের কিছু নাই। কেয়ারটেকার দাবী ছিল জামায়াতে ইসলামীর। আওয়ামী লীগ একই দাবীতে আন্দোলন করেছে। মিয়া গোলাম পরোয়ার বলেন, তখন জনমতকে উপেক্ষা করে একটি নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ওই নির্বাচনে গঠিত সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। কেয়ারটেকার দাবী মেনে নিয়ে সরকার পদত্যাগ করলে আরেকটি নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। একইভাবে ২০০১ সালে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করেছে ৪ দলীয় জোট। তিনি আরো বলেন, জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভূমিকাকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যেভাবেই বিশ্লেষণ করুক. জামায়াতের ভূমিকা সব সময়ই দেশ, দেশের মানুষের কল্যাণ, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিল।
ট্রাইব্যুনালের বিচারে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে মিয়া গোলাম পরোয়ার বলেন, জামায়াতে ইসলামী সব সময়ই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। সরকার পরিকল্পিতভাবে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ফাঁসি দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ইতোমধ্যে পরিস্কার হয়ে গেছে। বিচারে অংশ গ্রহণ করে মানুষকে দেখিয়ে দিতে পেরেছে এ সরকার কিভাবে আইনের অপব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছে। ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল বিভাগে বিষয় গুলো আলোচনার ফলে এখন সবাই পরিস্কার ধারণা পেয়েছেন বিচারের নামে কি ঘটেছে। মামলা গুলো যে ভিত্তিহীন পরিকল্পিতভাবে সাজানো সেটা এখন দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত।
মামলায় অংশগ্রহণ করা নিয়ে ডিফেন্সের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক যা বলেনঃ
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের অংশ নেয়ার প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক খোলাখুলি কথা বলেন ইউকে আমার দেশ-এর সাথে। বিচারে অংশ নেয়াকে কোনভাবেই ভুল সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিতে রাজি নন তিনি। তাঁর মতে বিচারে অংশ নিয়ে তারা ভুল করেননি। বরং সাকসেসফুল হয়েছেন। বর্তমানে এই বিচার যেভাবে সাজানো নাটক হিসাবে মানুষ পরিস্কার ধারনা লাভ করেছে, বিচারে অংশ না নিলে সেটা সম্ভব হত না। তখন দ্রুততার সাথে একতরফা সব শেষ করে রায় কার্যকর করা হত। বিচারে অংশ নেয়ার ফলে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে এটা ছিল পুরোপুরি পূর্ব সাজানো রায়। তাঁর সাথে আমার দেশ-এর কথোপকথনটি নিম্নরূপ-
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সরকারের সাজানো বিচারে অংশ নেয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল কি না এনিয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ডিফেন্স টিমে ৩টা পার্ট জড়িত ছিল। (১) দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামী, (২) ভিকটিম ও তাদের পরিবার এবং (৩) আইনজীবী। এই ৩ পক্ষ মিলে বিষয়টি নিয়ে প্রথমেই বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সরকারের এই পরিকল্পিত বিচারে অংশ নিয়ে এটাকে বৈধতা দেয়া হবে কিনা এবিষয়টিও আলোচনায় এসেছে তখনই। সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করেই সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মামলাগুলো ট্রাইব্যুনালে মোকাবেলা করা হবে। তিনি বলেন, ‘একজন আইনজীবী হিসাবে তখনো আমি তাদের বলেছি, ক্লায়েন্ট হিসাবে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেই অনুযায়ী অগ্রসর হব। ব্যক্তিগত মতামতে তখন এটাও বলেছি, বিচারে অংশ নিলে বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটাকে বৈধতা দেয়া হবে। তবে আমার মতামত ছিল ফাইট করা, তাদের কেইস যে বানানো সেটা প্রমাণের চেষ্টা করা। ক্লায়েন্ট হিসাবে নেতৃবৃন্দ খুব ঠাণ্ডা মাথায় তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
এখনো কি মনে করেন বিচারে যাওয়া ঠিক হয়েছিল? নাকি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল? জবাবে তিনি বলেন, যদি বিচারে আমরা না যেতাম, তখন খুব তাড়াতাড়ি মামলাগুলো শেষ করে রায় কার্যকরের দিকে অগ্রসর হত সরকার। এতে দেখা যেত ২০১১ সালের মধ্যেই সব শেষ করে দিতে পারতেন তারা। ডিফেন্স মামলায় অংশ না নিলে এ গুলো যে সাজানো, সরকারের পরিকল্পিত রায়, এসব এক্সপোজ করা সম্ভব হত না তখন। ডিফেন্স মামলায় অংশ নেয়ায় বিষয় গুলো এখন জাতির সামনে পরিস্কার হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও এক পর্যায়ে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে বললেন, আপনারা কেন মামলায় অংশ নিচ্ছেন? সরকারের সাজানো বিচারকে কেন বৈধতা দিচ্ছেন? তিনি নিজেও একাধিকবার আইনজীবী প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কথায় ভিকটিম নেতৃবৃন্দ অনেক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছিলেন। এনিয়ে সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামরুজ্জামান সাহেব অনেকটা বলেই ফেললেন বিচারে অংশ নেয়া ঠিক হচ্ছে না। আমীরে জামায়াত (মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী) তখন বললেন, সরকারকে ওয়াকওভার দেয়া ঠিক হবে না। ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, এই পর্যায়েও বলেছি, আমরা আসছি আইনজীবী হিসাবে। আপনারা যে সিদ্ধান্ত দেবেন সে অনুযায়ী আমরা অগ্রসর হব। তখনো ক্লায়েন্টদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল ট্রাইব্যুনালে ফাইট করা।
স্কাইপ স্ক্যান্ডাল প্রকাশের পর তো স্পষ্ট হয়ে গেল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সরকার নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। স্কাইপ স্ক্যান্ডালের মাধ্যমে জাতির সামনে এটা স্পষ্ট হওয়ার পরও আপনারা কেন অংশ নিলেন?
এ প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, এটা ঠিক স্কাইপ স্ক্যান্ডাল প্রকাশের মাধ্যমে বিষয়টি পুরোপুরি এক্সপোজ হয়েছিল। তবে তখনো ক্লায়েন্টদের সিদ্ধান্ত ছিল মামলা চালিয়ে যাওয়া। লিগ্যাল প্রফেশনে আইনজীবীর কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হল ক্লায়েন্টের মতামত। ক্লায়েন্ট যেভাবে চায় সেটাকে প্রাধান্য দেয়া। বৈধতা দেয়ার প্রশ্ন কামরুজ্জামান সাহেব সব সময় তুলেছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে সবার সিদ্ধান্ত ছিল বিচারে অংশ নেয়া। ক্লায়েন্ট এবং পরিবারের কেউ চায়নি বিচার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে।
সর্বশেষ অর্জন কি? এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিচারে অংশ নিয়ে সাকসেসফুল হয়েছি। যদি অংশ না নিতাম তবে খুব দ্রুত এক তরফা সব শেষ করে নিয়ে ফাঁসি কার্যকর করত। তখন দেখা যেত ২০১১ সালের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেছে। এখন যে বিষয়গুলো আলোচনা হচ্ছে এ গুলোর কোন প্রসঙ্গই থাকতো না। এই যে স্কাইপের বিষয়টি। যেটিতে তুমি নিজেও জড়িত (প্রশ্নকারী রিপোর্টারকে উদ্দেশ্য করে), যদি মামলায় ফাইট না করা হত, এ বিষয় গুলো তখন জাতির সামনে আসত না। বা আসার প্রয়োজনও পড়ত না। কারণ তারা সবকিছু একতরফা করে নিয়ে ফাঁসি দিয়ে দিত। বহু আগেই সব শেষ হয়ে যেত। মামলা গুলো যে সাজানো এটা এখন দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত বিষয়। প্রতিকূলতার মাঝে এটাই বড় অর্জন যে মামলা গুলো সাজানো ছিল, এটা দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক অনেকবারই ২০১১ সালে সব শেষ হয়ে যেত বললেও আমার দেশ ইউকে’র তরফ থেকে তাঁর কাছে ভিন্ন প্রশ্ন ছিল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে স্কাইপ কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামির ক্যাঙ্গারু আদালতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা এটাই মূলত জানতে চাওয়া হয়েছিল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন