বাংলাদেশে গণতন্ত্র ধ্বংস এবং ফ্যাসিবাদের উত্থানে কথিত সুশীলদের ভূমিকা ও অপতৎপরতা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংবিধানে সকল নাগরিকের বৈষম্যহীনতার কথা বলা রয়েছে। অথচ, নিজেদের ব্রাহ্মণ হিসাবে হাজির করে সমাজে বৈষম্যের দেয়াল তৈরি করছেন এই সুশীলরাই। কথিত কিছু সুশীল ছাড়া বাকী সকল জনগণকে তারা তুচ্ছ মনে করেন। এই সুশীল গোত্রের লোকদেরই কখনো সুশাসনের কথা বলে আবার কখনো যোগ্য প্রার্থী বাছাই আন্দোলনের শ্লোগান দিয়ে সরব সরব হতে দেখা গেছে ২০০২ সাল থেকে। কারণে অকারণে তাদের প্রায় প্রতিদিন দেখা যেত জাতির সামনে নানা সবক নিয়ে হাজির হতে।
এই সুশীল গোষ্ঠী ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে তাদের প্রথম লক্ষ্য হাসিল করে। সেই লক্ষ্য হাসিলে সুশীলদের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে, ইসলাম বিদ্বেষী এবং এক সময়ের বাম আন্দোলনের নেতা প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ট্রাষ্টি দেবপ্রিয় ভট্টাচায এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সুলতানা কামাল চক্রবর্তী গংদের। তাদের নেতৃত্বেই তখন নানা ইস্যু বানিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির পালে হাওয়া দেয়া হয়।
অথচ, ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং লুটপাট নিয়ে তাদের কোন আওয়াজ নেই। দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন শূন্যের কোঠায়। ফ্যাসিবাদ চরম রূপ ধারণ করছে। ভিন্নমতের রাজনীতিক এবং গণমাধ্যমকে গলাটিপে ধরা হয়েছে। তারপরও এই সুশীলরা নীরব । বরং ক্ষেত্র বিশেষে তাদেরকে ভিন্নমত দমনের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়।
সুশীলদের ঐক্য ও নানামুখী তৎপরতা
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরী আইন জারির মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকারী সরকারকে সুশীল গোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের আন্দোলনের সরকার হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। জরুরী আইনের সরকারের আইন মন্ত্রীর সাথে সম্পাদকদের এক বৈঠক শেষে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে হাজির হয়ে মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘এ সরকার হচ্ছে আমাদের আন্দোলনের ফসল’। সেনা নিয়ন্ত্রিত এ সরকারের হাত ধরেই দেশ ফ্যাসিবাদের পথে এগিয়ে যায়। এই সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারই প্রণব মুখার্জীর মধ্যস্থতায় শেখ হাসিনার সাথে সমঝোতার নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। এই সুশীলদের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের সার্বভৌমত্বকে ভারতের পদতলে সমর্পণ করা।
সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই মতিউর রহমান প্রথম আলোতে বিশেষ সম্পাদকীয় লিখেন। ‘দুই নেত্রীকে বিদায় নিতে হবে’ শিরোনামে লেখা বিশেষ সম্পাদকীয়তে দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে এগিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয় জরুরী আইনের সরকারকে। এর আরো আগে সুশীলদের মধ্যে একটি ঐক্য তৈরি হয়। ২০০৩ সাল থেকেই সিপিডি-প্রথম আলো-ডেইলি স্টার ও চ্যানেল আই-এর সৌজন্যে যৌথভাবে একটি সুশীল আন্দোলন শুরু হয় দেশে। ‘যোগ্য প্রার্থী বাছাই আন্দোলন’ নামে দেশব্যাপী সভা সেমিনার করা শুরু হয় সিপিডি, ডেইলি স্টার, প্রথম আলো এবং চ্যানেল আইয়ের যৌথ উদ্যোগে। এই সভা সেমিনারের মাধ্যমে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির প্রকল্প হাতে নেয় সুশীলরা। প্রতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় তাদের বাছাই করা লোক দিয়ে যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের সভা হত তখন। সভা গুলো চ্যানেল আই লাইভ প্রচার করত। সভা গুলোতে আলোচনার মূল বিষয় ছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে বিষোদগার করা। স্থানীয় জনমতকে তৎকালীন সরকার দলীয় জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিরোধী দলীয় জোটের আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস এবং জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিকে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে উস্কে দেয়াই ছিল সুশীলদের মূল কাজ। আর বুঝে হউক বা না বুঝে হউক তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকারে থাকা কতিপয় সুশীল গোত্রের নেতারাও এসব কর্মকাণ্ডে হাততালি দিয়ে সমর্থন দিতেন। এইসব সুশীলদের প্রোপাগান্ডার ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর গণতান্ত্রিক সরকারের বিদায়ের দিনে রাজপথে প্রকাশ্যে মানুষ পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঐ পৈশাচিকতার কোন রকম নিন্দা না জানিয়ে বরং দেশব্যাপী চরম নৈরাজ্য তৈরিতে সুশীলরা অবদান রাখেন।
সেনা অভ্যূত্থানের চুড়ান্ত প্রেক্ষাপট তৈরি করতে সুলতানা কামাল চক্রবর্তী, আকবর আলী খান, সিএম শফি সামি ও হাসান মশহুদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে আকষ্মিক পদত্যাগ করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে জরুরী আইনের নামে সুশীলদের সরকার গঠন করেছিল।
জরুরী আইনের সরকারকে সুশীলদের নিরঙ্কুশ সমর্থন
জরুরী আইনের সরকারের প্রতি সুশীলদের ছিল নিরঙ্কুশ সমর্থন। দখলদার অগণতান্ত্রিক সরকারকে সুশীলরা নিজেদের সরকার হিসাবে পরিচয় দিয়ে গর্ব অনুভব করত । যদিও এই সুশীলরাই গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেন। ২০০২ সাল থেকে বিভিন্ন ইস্যু-নন ইস্যুতে এসব সুশীলরা কারনে অকারনে সরব থাকতেন । মানবাধিকারের নানা সবক নিয়ে হাজির হতেন জাতির সামনে। ১/১১-এর সরকারের সময় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হলেও সুশীল গোষ্ঠী সমর্থন দিয়ে গেছেন। এজন্য সুশীলরাও নানাভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন সেনা সমর্থিত সরকারের পক্ষ থেকে।
উল্লেখ্য, যোগ্যপ্রার্থী আন্দোলনের মূল নেতা ড. দেবপ্রেয় ভট্রচার্য, পুরষ্কার হিসাবে মঈন ও মাসুদ গংদের অধীনে রাষ্ট্রদূতের চাকুরি নিয়ে জেনেভা চলে যান। তাঁর জন্য বিশেষভাবে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশী স্ত্রী রাখা সংক্রান্ত আইনও সংশোধন করা হয়।
শাহবাগের প্রতি সুশীলদের সমর্থন
গত ১৪ বছরে অগণতািন্ত্রক শাসনকালে কেবল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুশীলদের নড়েচড়ে বসতে দেখা গিয়েছিল। সুশীলরা জেগে উঠেছিলেন ভিন্নমতের রাজনীতিকদের বিনা বিচারে ফাঁসির দাবীতে। তারা তখন একটি বিদেশী দূতাবাসের ইঙ্গিতে ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগার গোষ্ঠীেক সাথে নিয়ে শাহবাগ সার্কােসের সূচনা করেছিলেন।। সেই সময় ভিন্নমতের গণমাধ্যমকে লাঠির ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দিতে সুশীলদের প্ররোচনায় শাহবাগ থেকে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদকের অফিস অভিমুখে লাঠি মিছিল বের করা হয়েছিল। সুশীলদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদচারণায় মুখরিত শাহবাগে সেদিন ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। সুশীলরা দলে দলে এসে ফ্যাসিবাদের উত্থানে শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেন । ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় সুশীলদের গণতন্ত্র বিনাসী কার্যক্র এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার।
মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভিন্নমতের রাজনীতিকদের ধরে নিয়ে গুম, পুলিশ কর্তৃক রাজপথে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে দুর্নীতি-দু:শাসনের বিরুদ্ধে চিহ্নিত সুশীল গোষ্ঠী এখন নীরব। তারা যেন সেই দিনের যোগ্যপ্রার্থী বাছাই আন্দোলন, মানবাধিকারের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। অবশ্য বাজারদর ধরে রাখার জন্য মাঝে মধ্যে দু-একটি ইস্যুতে লোক দেখানো কিছু বললেও ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখতেই তারা মরিয়া।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন