ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্য দিয়ে সরকার জনগণের কণ্ঠরোধ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি শুরু থেকেই বলে এসেছে এই আইন কালো আইন। এই আইন সংবিধান বিরোধী এবং এই আইন জনগণের কণ্ঠ রোধ করার জন্য সরকারের হাতিয়ার। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই আইন করেছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’র জন্য সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন না মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘জানুয়ারি, ২০২০ সাল থেকে জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২ জন সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়েছেন। ইতোমধ্যেই সংবাদপত্র- সম্পাদক পরিষদ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’র জন্য সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন না। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই কালো আইন বাতিলের দাবি তুলেছে।’
শুক্রবার (১৪ আগস্ট) সকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ বিষয়ে ভার্চুওয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বিএনপি মহাসচিব বলেন, `আজ আপনাদেরকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র পক্ষ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা হরণের সরকারি নীলনকশার চিত্র তুলে ধরতে চাই। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সংবিধান আমাদের গর্বের ও অহংকারের বিষয়। বর্তমান সরকার প্রতিনিয়ত আমাদের সেই অর্জন, আমাদের গর্বের, অহংকারের গৌরবের স্বাধীনতার চেতনা এবং সংবিধানের পবিত্রতাকে লঙ্ঘন করছে, অপমান করছে যা আমাদের মতো আপনারাও অনুভব করছেন। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ মানুষের চিন্তা-চেতনা, মত প্রকাশ ও বিবেকের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই মৌলিক অধিকার, চিন্তা চেতনার অধিকার, মতপ্রকাশ ও বিবেকের স্বাধীনতাকে বৈষম্যমূলকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অপমান করা হচ্ছে, যার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্যসূত্র বিশেষ করে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’র তথ্যমতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৫৩ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে। প্রায় সবগুলো মামলার কমন অভিযোগ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশের জন্য তথাকথিত সম্মানহানি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপরাধ। এসব অভিযোগসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন, সরকারি দলের লুটেরাদের বিরুদ্ধে কথা বললে, রাজনৈতিক মত প্রকাশ করলে, সরকারের সমালোচনা করলে মামলা করা হয়েছে। মামলার ভয়ে আজ জাতির কণ্ঠ রুদ্ধ, বিবেকের স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত। যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।’
তিনি আরও বলেন, `মানবাধিকার সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) কার্যকর রয়েছে। আর্টিকেল ১৯-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২২ জুন পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ১০৮ টি। এই সব মামলায় মোট আসামি ২০৪ জন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক ৪৪ জন, আর অন্যান্য পেশায় কর্মরত ও সাধারণ মানুষ ১৬০ জন। এই হিসেবে প্রায় ২৫ ভাগ আসামিই হলেন সাংবাদিক।’
এরমধ্যে মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১০, ফেব্রুয়ারিতে ৯, মার্চে ১৩, এপ্রিলে ২৪, মে-তে ৩১ এবং জুন মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত ২১টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
আর্টিকেল ১৯ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ৬৩টি। ২০১৮ সালে ডিএসএ এবং আইসিটি অ্যাক্ট মিলিয়ে মামলা হয়েছে ৭১টি। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এক বছরে মোট মামলা হয়েছে ৬৩টি। আর সেখানে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই মামলা হয়েছে তার চেয়ে বেশি, ১০৮টি।
ফখরুল বলেন, `সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের তথ্য মতে, বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। কারণ অনেক মামলার খবরই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়না। তাই মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তার খোঁজ পায়না। ফলে তাদের সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি মাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আছে ঢাকায়। ডিজিটাল এবং তার আগের আইসিটি আইনের সব মামলার হিসাব আছে সেখানে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এই বছরের মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে মোট ৩২৭টি। জানুয়ারি মাসে মোট মামলা হয়েছে ৮৬টি। এরমধ্যে থানায় ৪১টি এবং আদালতে ৪৫টি। ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছে ১১৯টি মামলা। থানায় ৯৫টি এবং আদালতে ৩৪টি। মার্চ মাসে মামলা হয়েছে ১২২টি। এরমধ্যে থানায় ৭৫টি এবং আদালতে ৩৭টি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘২০১৯ সালে মোট মামলা হয়েছে এক হাজার ১৮৯টি। এর মধ্যে থানায় ৭২১টি এবং আদালতে ৪৬৮টি। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৫০টির মতো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন মামলা আছে এ পর্যন্ত মোট এক হাজার ৯৫৫টি। এরমধ্যে থানায় দায়ের করা এক হাজার ৬৬৮টি এবং আদালতে ২৮৭টি। ৫৫টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে।’
তিনি বলেন, ‘এই আইনের নগ্ন শিকার হয়েছেন অন্যান্যদের মধ্যে ৮৫ বৎসরের বেশি বয়সের সম্পাদক জনাব আসাদউদ্দিন, সাংবাদিক কাজল ফকির, নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল, ব্যবসায়ীসহ অজস্র নিরীহ নাগরিক। আমরা অবিলম্বে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।’
বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করে বলেন, ‘এই আইনে হয়রানির অন্যতম একটি দিক হলো, সারা বাংলাদেশে একটি মাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল যা ঢাকাতে অবস্থিত। এই আইনের অধীনে কোনও আপিল ট্রাইব্যুনাল এখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কোনো ব্যক্তি বা সাংবাদিক ফেসবুকে সরকারের লুটপাটের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা করলে, তার বিরুদ্ধে মামলা সংশ্লিষ্ট থানা করলেও তার বিচার হবে ঢাকায় অবস্থিত একমাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে। একবার ভাবুন, ন্যায়বিচার কতটা দুরূহ করেছে এই স্বৈরাচার।’
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাগুলোর মূল অভিযোগ হলো, “ব্যক্তির মানহানি, আক্রমনাত্মক মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শন কিংবা রাষ্ট্রের তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ করা, ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা”। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন, এই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা প্রতিনিয়ত কিভাবে বিরোধীদলীয় কিংবা ভিন্নমতাবলম্বীদের সম্মানহানি করছে, কিভাবে আক্রমণাত্মকভাবে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করছে, কিভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। এই সরকারের মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশের লুটপাট কিভাবে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। আমাদের গর্বের বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বা সুনাম আজ বিশ্বদরবারে দুর্নীতির সূচকের তলানিতে। ১২৮টি দেশের মধ্যে ১১৫তম।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এ সরকারের নেতাকর্মীদের করোনা সার্টিফিকেট বিক্রির কারণে ইতালিতে বাংলাদেশ থেকে আগত কোনও ব্যক্তিকে ঢুকতে দেয়া হয় না। নিউইয়র্ক টাইমসে নেতিবাচক প্রবন্ধ হয় বাংলাদেশকে নিয়ে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শীর্ষ দেশগুলোতে বাংলাদেশ উঠে আসে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্নের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি কর্মকাণ্ড বা সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে কি তাহলে এই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দণ্ডিত হবেন না? প্রধানমন্ত্রী কি তাঁর দায় এড়াতে পারবেন?’
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন