জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ১৪ জুলাই। সেইসঙ্গে এরশাদবিহীন পখচলার একবছর পূর্ণ করছে জাতীয় পার্টি। চেয়ারম্যান এরশাদের জীবদ্দশাতেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে অনৈক্য ও গ্রুপিং তৈরি হয়েছিল, তবে সেইভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠতে পারেনি। জাপার প্রতিষ্ঠাতার পর দলের সেই দ্বিধাবিভাক্তি আরও চওড়া হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে।
একবছর আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর পরই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। জাপা প্রতিষ্ঠাতা নির্দেশিত পার্টির শীর্ষপদে এখন পর্যন্ত তার ভাই জি এম কাদেরের হাতে রয়েছে। বিশেষ করে জাপার কেন্দ্রীয় সম্মেলনে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর সমর্থন নিয়ে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শক্ত হাতেই জাপার হাল ধরে আছেন। তবে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর পার্টির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে বেগম রওশন এরশাদসহ দলের একটি অংশকে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বর্তমানে জাপার কো-চেয়ারম্যানদের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন ও দলের অভ্যন্তরীণ কর্মকান্ড নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
বেগম রওশন এরশাদ অনেকটাই নীরব স্বামীর মৃত্যুর পর । পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে তিনি যেমন উপস্থিত ছিলেন না, তেমন দলের অন্যান্য কর্মসূচিতে খুব বেশি অংশ নেন না। তবে বার্ধক্যের কারণেই মূলত তিনি সভা-সমাবেশে খুব বেশি অংশ নেন না বলে তাঁর একাধিক অনুসারী জানিয়েছেন। তবে নিয়মিতই তিনি পার্টির সব কর্মকান্ডের খোঁজখবর রাখেন। যখন প্রয়োজন হয়, তখনই অনুসারীদের নিয়ে তিনি সরব হন।
এরশাদের মৃত্যুর পরপরই জাপাশিবিরে নতুন করে আলোচনায় আসেন তাঁর সাবেক স্ত্রী বিদিশা। এরশাদের মৃত্যুর কয়েক মাস পর বিদিশা প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান নেন। তাঁর ছেলে এরিককে সামনে রেখে এরশাদের গড়া ট্রাস্টকে কেন্দ্র করেই মূলত বিদিশার কর্মকান্ড আলোচনায় আসে। গত এক বছর এ নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ লেখালেখি হয়েছে। বিদিশার আমন্ত্রণে এরিকের জন্মদিনে জাতীয় পার্টির কয়েকজন সিনিয়র নেতা, এরশাদের আরেক ছেলে সাদ এরশাদের উপস্থিতি বিদিশাকে সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে যায়। বর্তমানে এরশাদের গড়া ট্রাস্টের সব কর্মকান্ড বিদিশার পরামর্শে হচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের চলে যাওয়ার একবছর পূর্ণ হওয়ায় জাপার বর্তমান সংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, বেগম রওশন এরশাদের পরামর্শ ও জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই পার্টি চলছে। করোনার কারণে সব দলের মতো আমাদের পার্টির স্বাভাবিক কর্মকান্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। কিন্তু করোনায় অসহায় মানুষের মাঝে আমরা পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করেছি। ১৪ জুলাই পার্টি চেয়ারম্যানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এরশাদকে কেন্দ্র করেই মূলত চলত জাতীয় পার্টির রাজনীতি। কিন্তু এরশাদবিহীন জাপা যেমন সাংগঠনিক কর্মকান্ডে দুর্বল হয়ে পড়েছে, তেমন দলের অভ্যন্তরে অনৈক্যর সুর ফুটে উঠছে বলে জানিয়েছেন জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা বলছেন, একদিকে নেতৃত্বের কোন্দল। তিন ভাগে বিভক্ত জাপার কেন্দ্রীয় রাজনীতি। সারা দেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম একেবারেই বেহাল। ৪০টির বেশি সাংগঠনিক জেলায় কমিটি নেই বছরের পর বছর। তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠন এখন অস্তিত্বহীন বলা চলে। অন্যদিকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব তো আছেই। কর্মসূচির অভাবে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম একেবারে ‘নেই’ হয়ে গেছে। যদিও করোনা সংকটের দোহাই দিয়ে সংগঠন ভালো আছে এমন সান্তনা খোঁজার চেষ্টা শীর্ষ নেতাদের।
জাতীয় পার্টি র কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী রওশন। এরপর কাউন্সিলে জি এম কাদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সম্মেলনে করা নতুন কমিটিতে রওশনপন্থি অনেক সিনিয়র নেতাই স্থান পাননি। পরে তাঁদের অনেকেই যোগ দেন রওশনের পক্ষে।
বাবার মৃত্যুর পর এরশাদের অন্য পুত্র এরিক ছিলেন বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে। জমিসম্পদ এরশাদ ট্রাস্টের নামে দিয়ে গেলেও এ নিয়ে জটিলতা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট পার্কে এরিকের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন মা বিদিশা। ফলে বিদিশার সঙ্গে জাপার বঞ্চিত একটি অংশ যোগ দেয়। সম্প্রতি এরিকের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাদের প্রেসিডেন্ট পার্কে দেখা গেছে। আবার এরশাদের রংপুরের আসনে নির্বাচন করে পাস করা সাদ সম্প্রতি রংপুরের পল্লীনিবাসে দলীয় নেতা-কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে পার্টিতে চলছে তুমুল দ্বন্দ্ব। চলছে বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার। রংপুরের দুর্গ হিসেবে পরিচিত জাপার রাজনীতি এখন ভেঙে খানখান। গোটা উত্তরাঞ্চলের চিত্র একই বলা চলে। সব মিলিয়ে তিন ধারার রাজনীতিতে জাপার মেরুদন্ড বাঁকা হওয়ার দশা।
জাপার তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা পার্টির অধিকাংশ এমপির ওপর ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ, দলের ২২ জন নির্বাচিত ও চারজন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া কেউ সাংগঠনিক দায়িত্ব নিতে চান না। তাঁদের সঙ্গেও নেতা-কর্মীদের দূরত্ব রয়েছে। তাঁরা বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ব্যস্ত। ফলে সাধারণ নেতা-কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধায় পাশে থাকেন না।
পূর্বপশ্চিম
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন