করোনাভাইরাস মহামারীর ভয়াবহতা ‘বিবেচনায় না এনে’ সব কিছু খুলে দিয়ে সরকার ‘কানে তুলো দিয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “কাল থেকে দেখছি, যে রেলগাড়ি চলছে এবং ট্রেনগুলোতে সেই গাদাগাদি করে মানুষ আসছে। এরমধ্যে আপনারা দেখেছেন যে, বাসে রীতিমতো মারামারি হচ্ছে বাসে উঠার জন্য, জায়গা পাওয়ার জন্য।
“এটা সম্ভব না বাংলাদেশে, এভাবে গণপরিবহনকে নিয়ন্ত্রণ করবেন? যেখানে আপনি অফিস খুলে দিয়েছেন, অফিস খুললে তো লোকজন তো আসবেই। লঞ্চেও একই অবস্থা হয়েছে।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “এখন সরকারের অবস্থা হচ্ছে যে, ‘কানে দিয়েছি তু্লো’। তারা কানে তুলো দিয়েছে। কানে দিয়েছি তুলো, যা খুশি বলেন আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা তো আছি।”
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে অফিস খোলা ও গণপরিবহন চালুর সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “বার বার করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের (সরকার) নিয়োজিত যে টেনিক্যাল পরামর্শক কমিটি রয়েছে তারাও বলছেন যে, এটা (সব কিছু খুলে দেয়া) একটা সুইসাইডাল সিদ্ধান্ত। এটা করলে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি হবে। তারা সেই কথা শোনেননি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর যে ব্যক্তিগত চিকিৎসক যিনি আছেন আবদুল্লাহ (অধ্যাপক এম আবদুল্লাহ) সাহেব, তাকে অ্যাডভাইজার হিসেবে নেওয়া হয়েছে তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন যে, এটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে, সংক্রমণ আরো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে।”
সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘ব্যর্থ হয়েছে’ মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা মনে করি, এটার জন্য আরও সময় নিতে পারত। ভারতে দেখেন, তারা সব রাজ্যের চিফ মিনিস্টার, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিদের সঙ্গে কথা বলেছেন, কথা বলে আরও এক মাস লকডাউন বাড়িয়েছে।
“যে কথাটা আমি বার বার বলেছি, দায়িত্বশীলতা নেই বলেই সরকার এভাবে তুঘলকি কারবার করছেন যেটা জনগণকে পুরোপুরিভাবে মহাবিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”
‘সরকার কোথায়?’
ব্যাংক ঋণ অনুমোদন নিয়ে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অপহরণ ও হত্যার হুমকি দিয়ে আরেক বেসরকারি ব্যাংকের দুই পরিচালক ভাইয়ের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এ ঘটনায় সরকার কী ভূমিকা পালন করেছে সে প্রশ্ন তুলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “হোয়ার ইজ গভার্নমেন্ট, সরকার কোথায়? আজকে এই কারণে এতো ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছে সেজন্যই।”
ফখরুল বলেন, সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছু বললেই উসকানি দেওয়া হচ্ছে বলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়।
“একজন তো প্রায়ই বলেন যে, বিষোদগার করবেন না। আরে বিষোদগার করে আপনারা যে অবৈধভাবে সরকার দখল করে আছেন সেটা বলছি না। আমরা বলছি যে, আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন এটা পারছেন না করতে, এই জিনিসটা করা উচিত ছিল।
“এই জিনিসগুলোই আমরা বার বার করে বলছি। কিন্তু ওই যে, কানে দিয়েছি তুলো। যা খুশি বলেন আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা তো আছি।”
তবে এভাবে ‘কানে তুলো’ দিয়ে টিকে থাকা যায় না বলে সতর্ক করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
“জনগণের চাহিদা যদি পূরন করা না যায়, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা যদি পূরণ না করা যায়, আর যদি ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে তাহলে কিন্তু থাকে না, চিরকাল থাকে না।”
বাসভাড়া বৃদ্ধি ‘অমানবিক’
করোনাভাইরাস সংকটের এই সময়ে বাস ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে ‘অমানবিক’ আখ্যায়িত করেছেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, “এমনিতেই মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বাসে কারা উঠে? কম আয়ের সাধারণ মানুষেরাই বাসে উঠে। তাদের বাস ভাড়া বাড়িয়ে দিল। কার স্বার্থে বাড়িয়েছে?
“মালিকদের স্বার্থে বাড়িয়েছে। মালিকদের আবার প্রণোদনা দিচ্ছে, অনুদান দিচ্ছে। পুরো বিষয়টা হয়েছে লুটপাটের জন্য, পুরোপুরি লুটপাট। শুধুমাত্র দুর্নীতির চরমভাবে সুযোগ নিচ্ছে সবাই।”
গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিটের অনুমোদন এখনও না দেওয়ার সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।
এর পেছনেও ‘দুর্নীতি’ রয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “মানুষের এই দুর্দিনে যারা মানুষের স্বাস্থ্যকে, জীবনকে পুঁজি করে ব্যবসা করার, বাণিজ্য করার সুযোগ দেয় সেই সরকারকে কি আমরা দুর্নীতিমুক্ত বলতে পারব? পারব না।
“আমরা তাই আশা করব, তারা (সরকার) ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরিয়ে নিয়ে জনগণের জন্য কাজ করবেন।”
করোনাভাইরাসের কারণে কৃষি ও কৃষকদের ক্ষতি যাতে না হয় সেজন্য ১০ দফা প্রস্তবানা তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।
তাদের প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, আগামী এক বছর পোল্ট্রি ও ডেইরিসহ সব ধরনের কৃষি ঋণের কিস্তি সুদসহ মওকুফ; বীজ, সার, কীটনাশক, সেচে ভুর্তর্কিসহ প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, কৃষিপণ্যসহ আম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা প্রভৃতি ফল সরকারি উদ্যোগে বাজারজাত নিশ্চিতকরণ, কৃষকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, কৃষকদের উৎপাদিত ধানের বিপরীতে কমপক্ষে তিন মাসের সমপরিমাণ টাকা বিনা সুদে প্রদান, কৃষকদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণ ধান কিনতে অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ, প্রান্তিক চাষী ও ক্ষেতমজুরদের জন্য বিশেষ সুদবিহীন ঋণ ও কৃষকদের হয়রানি বন্ধ করে তাদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ও চাল কেনার ব্যবস্থা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের নেওয়া কর্মসূচিও ঘোষণা করেন মির্জা ফখরুল।
১০ জুন প্রতি জেলায় প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে চলতি মৌসুমে বোরো ধান কেনার দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি পেশ, আর্থিক ও পরিবহন সংকটে যে সব কৃষক ধান বিক্রি করতে পারছে না তাদেরকে কৃষক দল থেকে সহায়তা প্রদান এবং প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে চলমান ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রাখার কথাও জানান তিনি।
ফখরুল বলেন, “আমরা মনে করি, সরকারের সিদ্ধান্তগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত ছিল। যেমন ধরেন কৃষির ব্যাপারে বলি, সবাই জানি কৃষি আমাদের মেরুদণ্ড। এই করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা কিন্তু এই কৃষি। অর্থাৎ এই কৃষিকে যদি আরও উজ্জ্বীবিত করতে পারেন, উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারেন, কর্মসংস্থান সেখানে বাড়াতে পারেন তাহলে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। ওই দিকে কিন্তু দেখবেন সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে সেই প্রণোদনার মধ্যে কৃষি একেবারেই অবহেলিত হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রয়াত শিল্পপতি আব্দুল মোনেম, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দ, শিক্ষাবিদ আবদুল কাদের ভুঁইয়াসহ করোনাভাইরাসে মৃতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ফখরুল।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, তার স্ত্রী শিরিন পারভিন হক, ছেলে বারিশ হাসান চৌধুরী, প্রবীণ আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান ও তার স্ত্রীসহ গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের আশু রোগমুক্তি কামনা করেন তিনি।
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
সংবাদ সম্মেলনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান কৃষক দলের আহ্বায়ক শামসুজ্জামান দুদু, সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন, সদস্য মেহেদি হাসান পলাশ, অধ্যাপক শামসুর রহমান শামস, বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন নসু, চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান ও শামসুদ্দিন দিদার উপস্থিত ছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন