করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সঙ্কটে পড়েছেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। একরকমভাবে তাদের মানসম্মান হরণ করা হয়েছে বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। কারণ প্রত্যেকটা জেলায় সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বস্তুত মন্ত্রীদের কর্তৃত্ব এবং অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে মন্ত্রণালয়গুলোতে এখন সচিবরা বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন, অনেক মন্ত্রণালয় মন্ত্রীদের পাশ কাটিয়ে সচিবরা কাজ করতে চাইছেন। অনেক মন্ত্রণালয় সচিব এবং মন্ত্রীর পরস্পর বিরোধী অবস্থানের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এটি যে সরকারের মধ্যে একটি মেরুকরণের সঙ্কট তৈরী করছে শুধু তা নয়, রাজনৈতিক অস্তিত্ব এবং একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর এ কারণেই অনেক মন্ত্রী, বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক মন্ত্রী তারা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
সাম্প্রতিক সময় কিছু মন্ত্রীর দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড আমাদের চোখে পড়েছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মন্ত্রিসভায় হাতেগোনা যে কয়জন রাজনৈতিক মন্ত্রী রয়েছেন তাদের কর্তৃত্বেই মন্ত্রণালয় পুরোটা ছিলো। সচিবরা তাদের নির্দেশিত পথেই গাইডলাইন মেনে কাজ করতেন।
কিন্তু সমস্যা হয়েছে যখন ৬৪ জেলায় সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একের পর এক সচিবদের নিয়ে বৈঠক করা হচ্ছে। মন্ত্রীরা যখন কিছুই জানেন না তখন ওই সমস্ত মন্ত্রণালয়ে সচিবরা একটু নড়েচড়ে বসেন, নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার কিছু প্রয়াস পান। কিন্তু রাজনৈতিক মন্ত্রীরা তাদের কর্তৃত্ব ভালোভাবেই অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি তার মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো তদারকি করছেন এবং তার মন্ত্রণালয় অধিনস্থ বিভিন্ন বিভাগে কি ধরণের কাজ হচ্ছে সে সম্পর্কে তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের হালনাগাদ তথ্য তিনি নিচ্ছেন। বাসা থেকে তিনি নিয়মিত অফিস করছেন। তার মন্ত্রণালয়ে কখনো চ্যালেঞ্জ হয়নি বরং সকলে তার নেতৃত্বেই কাজ করছেন।
আরেক রাজনৈতিক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। রাজনৈতিক মন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই মন্ত্রণালয়ের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব তাঁর হাতেই ছিল। তবে করোনা সঙ্কটের সময় তিনি সমন্বয়ের অভাব, দ্বৈত নেতৃত্বের মতো কিছু সঙ্কটের মধ্যে পড়েছেন বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশেষ করে ধান কাটার জন্য যখন কৃষকদেরকে সংগঠিত করা এবং ধান কাটার জন্য যেন মানুষ যেতে পারে সেই ব্যবস্থার জন্য কৃষিমন্ত্রীর উদ্যোগ সচিবালয়ের আমলাদের দ্বারা বাধাগ্রস্থ হয়েছিল বলেও একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। কৃষিমন্ত্রী যেহেতু রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ, সেজন্য তিনি তার কর্তৃত্ব পুন:প্রতিষ্ঠা করতে বেশি দেরি করেননি। ধান কাটা, কৃষকরা যেন ন্যায্য মূল্য পায় এবং সর্বোপরি কোন দুর্নীতি যেন না হয় সেজন্য কৃষিমন্ত্রী বেশ সরব। এর মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে নিজের কর্তৃত্ব বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয় সুখী পরিবার হিসেবেই কাজ করছে। সেখানে ড. হাছান মাহমুদের মন্ত্রীত্ব নিয়ে যেমন প্রশ্ন নেই তেমনি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে তেমন কোন দ্বন্দ্ব দেখা যায় না। যার ফলে তথ্য মন্ত্রণালয়ে কোন কর্তৃত্বের লড়াই নাই। রাজনৈতিক মন্ত্রী হওয়ার কারণে পুরো মন্ত্রণালয়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্বই অক্ষুণ্ন রয়েছে। করোনার সময়ও তথ্য মন্ত্রীকে সরব দেখা গেছে। তিনি সাংবাদিকদের বেতন ভাতা এবং দুস্থ সাংবাদিকদের তালিকা গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন ও কথা বলেছেন। এছাড়া রাজনৈতিক বিষয়েও তাকে সরব দেখা গেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও কোন কর্তৃত্বের লড়াই দেখা যায়নি। এখানেও মন্ত্রী এবং উপমন্ত্রীর সমন্বয় রয়েছে। এখানে যে সচিববৃন্দ রয়েছেন, সেখানেও টানাপোড়েনের কোন খবর পাওয়া যায়নি।
তবে যে সমস্ত মন্ত্রণালয়ে রাজনৈতিক মন্ত্রী নেই, সেই সমস্ত মন্ত্রণালয়ে সচিবদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মন্ত্রীরা উপেক্ষিত হয়েছেন। দুয়েকটি মন্ত্রণালয় আছে যেখানে মন্ত্রীরা জানেনও না, আসলে কি হচ্ছে। কিছু কিছু অরাজনৈতিক মন্ত্রী অবশ্য তাদের কর্তৃত্ব উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক শেখর গভীরে না থাকার কারণে সেই চেষ্টা সফল হচ্ছে না।
সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্ধেকের বেশি মন্ত্রণালয় এখন সচিবদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে চলছে। তারাই মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। রাজনৈতিক মন্ত্রীরা যেখানে আছে সেখানেই তাদের কর্তৃত্ব রয়েছে। এ কারণে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এখন মরিয়া হয়ে আছেন অন্য মন্ত্রীরাও।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন