আসন্ন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘আন্দোলনের ইস্যু’ তৈরির সম্ভাবনা দেখছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। তবে এই জোটের অন্যতম শরিক বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনও আন্দোলনের প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীন। দলটির নেতারা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে কেবল ‘এগজিসটেন্স’ ধরে রাখাই এখন মূল কৌশল তাদের। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিদ্যমান কয়েকটি বিষয়ে ভুল-বোঝাবুঝির অবসানের চেষ্টা করছে দলটির হাই কমান্ড।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রভাবশালী এক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘ঢাকার দুই সিটি ভোট সুষ্ঠু হওয়ার ন্যূনতম প্রত্যাশা আমি করি না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপ ডেকে নির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে নির্বাচন আগের রাতেই ঘটেছে। এই সিটি ভোটেও তার ব্যত্যয় ঘটবে না। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকেই সামনে থেকে তাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।’
ঐকফ্রন্টের আরেক শীর্ষ নেতা বলেন, ঐক্যফ্রন্টে নির্বাচন-পরবর্তী বিষয় নিয়ে আগাম কোনও পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন ইস্যুতে রাজপথে কর্মসূচি দেওয়ার মতো কিছু থাকবে না।
ফ্রন্টের সূত্রমতে, আর সে কারণেই সম্ভবত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের বিজয় নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সরকারের একটি পক্ষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ শুরু হয়েছে। সূত্রটির ভাষ্য, বিএনপি অন্তত একটি মেয়র পেতে চাইছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র অবশ্য এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি। তবে দলীয়ভাবে তাবিথকে জেতাতে কোনও চেষ্টা হচ্ছে না জানিয়ে দলটির একাধিক নেতা বলেন, পারিবারিকভাবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্ক থাকার সুবাদে প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ কেউ চাইতেই পারেন তাবিথকে জেতাতে।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, বিগত ১০ বছর ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তাকে মোকাবিলা করে স্থিতিশীল পরিবেশ দৃঢ় করতে চায় বিএনপি। ইতিহাসগত ও রাজনৈতিকভাবে যে বিরোধ রয়েছে, যে বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ভুল-বোঝাবুঝি রয়েছে তার অবসান চাইছে দলটির হাই কমান্ড।
ঐক্যফ্রন্টের এক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ১৭ জানুয়ারি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মসূচির বিষয়ে আমাদের জবাব দিয়ে দিয়েছেন। তার জবাবের পর আমাদের কর্মসূচি নিয়ে চিন্তার সুযোগ কমে গেছে।’
গত ১৭ জানুয়ারি এক আলোচনা সভায় ঐক্যফ্রন্টের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আগামী ৩০ তারিখের (পরিবর্তিত তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি) ভোট কোনও ভোট নয়। ওই তারিখে ধানের শীষ জিততে পারবে না। ওরা জিততে দেবে না। যদি ভোট হতো তাহলে নৌকারই খবর থাকতো না। সে জন্যই সমস্ত বুদ্ধি-সুদ্ধি করেছেন তারা। ফখরুল ভাইয়ের সঙ্গে কর্মী হিসেবে কাজ করতে রাজি আছি। কিন্তু পুতুপুতু করে কোনও রাজনীতি হবে না।’
পরে মির্জা ফখরুল তার বক্তব্যে বলেন, ‘বিএনপি শুরু থেকে একটা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পলিটিক্যাল পার্টি। এর যে নিজস্ব চরিত্র আছে, সেই চরিত্র নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতির যে পরিবর্তন হয়েছে সেগুলোকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগোনো যাবে না।’
ওই আলোচনায় ২০১৪ সালের নির্বাচন, ২০১৫ সালে তিন মাসের অবরোধ আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে ফখরুল এ-ও বলেন, ‘আমাদের ভুল-ত্রুটি হয়েছে, সেই ভুল-ত্রুটি নিয়ে আমরা কিন্তু সরে দাঁড়াইনি। বিশ্ব রাজনীতির যে পরিবর্তন হয়েছে, সেই পরিবর্তনগুলোকে সামনে নিয়ে, সেগুলোকে পাশে রেখে আমাদের এগোতে হবে। আমরা আজকে হঠাৎ করে হঠকারী কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে চাই না।’
ফ্রন্টের একাধিক নেতার ভাষ্য, বিএনপির মহাসচিবের এমন বক্তব্যের পর দলে ও দলের বাইরে শরিক দলগুলোর মধ্যেও প্রতিক্রিয়া হয়। পরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৮৪তম জন্মবার্ষিকীর আলোচনায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ প্রশমিত করেন।
দুদিন আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে মুজিববর্ষ পালনের উৎসাহিত করে দ্বীপ্ত টেলিভিশনে একটি বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে তাদের উচিত সেভাবে সম্মান করা, করতেই হবে। না করলে আরও দূরে সরে যাবে তারা। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অবস্থান আছে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে আছেন তিনি।
পরে ড. কামালের বক্তব্যের বিষয়টি নানাভাবে তারেক রহমানের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তিনিও বিভিন্নভাবে খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট হন। তার মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ১৯ জানুয়ারি লন্ডনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের ৮৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় বক্তব্য দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের জন্য দল, মত ও আদর্শ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’
সিটি ভোটের পর কৌশল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের আগ্রহ নিয়ে কথা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে। তারা বলছেন, সিটি ভোট অবাধ হলে বিএনপির দুই প্রার্থীই জিতবে। তবে সরকারের সম্ভাব্য যে চিন্তা, তার পরিপ্রেক্ষিতেই ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কেবল রাজনৈতিকভাবে ‘এগজিসটেন্স’ ধরে রাখাই এখন কৌশল। নেতাদের দাবি, সিটি ভোট নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কর্মসূচি নিয়ে ভাবার কোনও সুযোগ নেই।
অন্য একটি সূত্রমতে, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে কর্মসূচির জন্য প্রস্তুত নয়।
তবে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে ছাত্রদলের একাধিক নেতা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভিপি নুরুল হক নুরু যেভাবে প্রতিনিয়ত মারধরের শিকার হয়েও প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন, বিএনপির কোনও নেতাই এক্ষেত্রে প্রশ্নহীন নন। বরং কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে তৃণমূলেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আড়ালে সম্পর্ক রক্ষার চল আছে। যেকোনও আন্দোলনের আগে দলকে এগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, “রাজনীতিতে ‘এগজিসটেন্স’ ধরে রাখা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে সক্ষম হলে বিএনপির তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন দুজনই জিতবেন। কিন্তু সরকার তো তা হতে দেবে না। সে কারণে ইভিএম ষড়যন্ত্র। আর কর্মসূচির আগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ঐক্য।’ ঐক্য না হলে আন্দোলন হবে কী করে—এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি।
উল্লেখ্য, আগামীকাল বুধবার (২২ জানুয়ারি) বিকালে ইভিএম নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করবে বিএনপি। গুলশানের হোটেল লেকশোরে এটি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান শায়রুল কবির খান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন