সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎ বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত। এরপরই বাংলাদেশে ইতিহাসের রেকর্ড ছাড়ায় পেঁয়াজের দাম। গত আড়াই মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেজি প্রতি ২৭০ টাকায় পৌঁছায় পেঁয়াজের দাম।
পেঁয়াজের এই দাম শুধু সাধারণ মানুষের কাছে নয় প্রভাব পড়েছে দেশের রাজনীতিতেও। বিরোধীরা এই নিয়ে সরকারের সমালোচনায় সোচ্ছার। তাদের দাবি, ‘সরকার দলীয় ব্যবসায়ীদের কারসাজীতে পেঁয়াজের এই দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে পেঁয়াজের সংকট সৃষ্টি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেট জড়িত। এই সিন্ডিকেটের পেছনে সরকারের মদদপুষ্ট ব্যক্তিরা কাজ করেছে। বলা হচ্ছে, সরকার আগে ধারণাই করতে পারেননি কত আসছে, কত রফতানি হচ্ছে। যার ফলে আজকে পেঁয়াজের মতো একটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু পেঁয়াজই নয় সকল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে।’
পেঁয়াজের বাজারে কারসাজির মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির যে চক্র এর পেছনে বিএনপি রয়েছে বলে দাবি করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন চাল, পেঁয়াজ, লবণ আর পরিবহনের ওপর ভর করছে। বারবার আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখনো শুধু ইস্যু খোঁজার চেষ্টা করছে।’
এদিকে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের সমালোচনাও করেন সাধারণ ভোক্তারা। সমালোচনা এরাতে পেঁয়াজের দাম কমাতে নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। দীর্ঘ দিন ধরে রাজনৈতিক বৈরিতা থাকা সত্বেও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। এই উদ্যোগে দীর্ঘ ১৫ বছর পর পাকিস্তানি পেঁয়াজ আসে বাংলাদেশের বাজারে।
ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার প্রেক্ষিতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বৈরি সম্পর্ক থাকা তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে বাংলাদেশ।
প্রভাব পড়েছে ভারতের বৈশ্বিক রাজনীতিতে
পেঁয়াজের দামে প্রভাব ভারতের বাজারেও। দেশটির কয়েকটি পেঁয়াজ উৎপাদনশীল রাজ্যে বন্যায় হওয়ায় পেঁয়াজ সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে পেঁয়াজের দাম ছুঁয়েছে ২০০ রূপির উপরে।
পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেখানেও রাজনীতি উত্তপ্ত। তবে দেশের রাজনীতির পেরিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতে প্রভাব পড়েছে ভারতের। পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ, যেহেতু তিনি অর্থনীতির নিম্নগতি ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছয় বছরের মধ্যে নিম্নতম পর্যায়ে চলে গেছে, এবং অনেকেই অর্থনীতির অবনতির আশঙ্কা করছেন।
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে অধিকাংশ খাবারেই পেঁয়াজের বাধ্যতামূলকতা রয়েছে। পেঁয়াজের কারণে ভারতে সরকারের পতনের নজির ইতিহাসে রয়েছে। ১৯৯৮ সালে দিল্লি আর রাজস্থানে এ কারণেই সরকারের পতন হয়েছিল। ১৯৮০ সালে পেঁয়াজের দামবৃদ্ধির কারণেই ইন্দিরা গান্ধির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ রাখাটা সহজ হয়েছিল। অনেকেই সেবারের নির্বাচনকে ‘পেঁয়াজের নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পেঁয়াজ রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আফগানিস্তান, তুরস্ক, ইরান ও মিশর থেকে ১০০,০০০ টন পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণা দেয় ভারত।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে কাশ্মিরের বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এর পর থেকেই তুরস্ক আর ভারতের সম্পর্কে শীতল অবস্থা বিরাজ করছে।
কিন্তু, পেঁয়াজের সংকট বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান সরকার আবারও আঙ্কারার কাছে ফিরেছে। দ্য প্রিন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশান ফান্ড ম্যানেজমেন্ট কমিটি (পিএসএফএমসি) ২২ নভেম্বর তুরস্কের কাছ থেকে ১১,০০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য টেন্ডার দিয়েছে। মাত্র একদিন আগে ২১ নভেম্বর তুরস্ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে, যেখানে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়।
এই প্রভাবের কথা স্বীকারও করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সম্প্রতি নয়াদিল্লীর রামনাথ গোয়েনকা লেকচারে তিনি বলেছেন, যতক্ষণ ভোগ্যপণ্যের বিষয় সামনে আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনীতিই ভারতের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকায় থাকবে।
অতীতে ভারত নিজেও প্রতিবেশী পাকিস্তান থেকে আমদানি করেছে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে পেঁয়াজের দাম যখন বেড়ে গিয়েছিল ভারতে তখন পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছিল।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন