গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে হত্যা করার পর পরই টার্গেট করা হয় তৎকালীন সময়ের জাতীয় পার্টির নেতা সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী (বর্তমান এমপি) ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে। আব্দুল কাদের খান স্বপ্ন দেখেন শামীম পাটোয়ারীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে এমপি হবেন তিনি।
ছক অনুযায়ী শামীম পাটোয়ারীর গতিবিধি লক্ষ্য করতে খুনি মেহেদি, শাহীন ও রানা রেকি (পর্যবেক্ষণ) করতে থাকেন। তার ঢাকাস্থ মহাখালীর চেয়ারম্যানবাড়ী এলাকার বাসা থেকে শুরু করে সুন্দরগঞ্জের গ্রামের বাড়ি সহ বিভিন্ন স্থানে সুযোগ পেলেই গুলি করে শামীম পাটোয়ারীকে হত্যার পরিকল্পনাও করেন আব্দুল কাদের খান।
সূত্র জানায়, খুনিরা এমপি লিটনকে হত্যার পর যখন শামীম পাটোয়ারীকে হত্যা করার কোনো সুযোগ পাচ্ছিলো না, তখন আব্দুল কাদের খান খুনিদের উদ্দেশে বলেন, “ ফিল্ড ফাঁকা করলাম আমি, এমপি হবে শামীম পাটোয়ারী? ”।
শুধু এমপি লিটন নন,কাদের সুন্দরগঞ্জের তিনজনকে হত্যার জন্য নামের তালিকা করেন। এমপি লিটন ছিলেন তার এক নম্বর টার্গেট। দুই নম্বর ছিলেন স্থানীয় জাপা নেতা বর্তমান সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। আর তিন নম্বরে ছিলেন ওই আসনের সাবেক এমপি ওয়াহেদুজ্জামান সরকার বাদশা।
রাজনীতির পথ পরিষ্কার করতেই এমপি লিটনসহ এই দুইজনকে হত্যার ছক করেছিলেন কাদের। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে এমপি হন লিটন। পরবর্তী নির্বাচনে তিনি যেন এমপি হতে পারেন এজন্যই লিটনসহ এই দুইজনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন কাদের।
২০০৮ সালে মহাজোট থেকে নির্বাচন করে এমপি হয়েছিলেন আব্দুল কাদের খান। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর কাদের খানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে টিআর-কাবিখা প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন লিটন। কর্নেল আব্দুল কাদের খানের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত চারটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এখান থেকেই চরম ক্ষোভের জন্ম হয় কাদেরের। এরপর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে পরাজিত হন কাদের খান। এমপি নির্বাচিত হন মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। চিরদিনের জন্য কাদেরের এমপি হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলে ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে। ছক করতে থাকে কিভাবে লিটনকে রাজনীতির মাঠ থেকে নয়, দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়া যায়। শুরু করেন তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের নিয়ে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কিলিং মিশনে সফল হওয়ার মতো কয়েকজন যুবককে খুঁজতে থাকেন কাদের। একপর্যায়ে ২০১৬ সালের মে মাসে প্রথম মিটিং হয় কর্নেল কাদেরের সুন্দরগঞ্জের খান পাড়ার বাড়িতে। সেখানে সহযোগী হিসেবে আগ্রহী বেশ কয়েকজনকে পেলেও পরে কিলিং মিশনে অংশ নেয় মেহেদি,শাহীন ও রানা। কাদের খান তার নিজ নামের লাইসেন্স করা একটি কালো রংয়ের পিস্তল সহ তিনটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলেন তাদের। শুধু তাই নয়,তাদেরকে ডায়াং রানার একটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়ে চালানোরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো কাদেরের নলডাঙ্গার গোডাউনে এবং ছাপড়হাটির খানপাড়ার নিজ বাড়িতে।
এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে এমপি লিটনকে প্রথমবার ঢাকা থেকে সুন্দরগঞ্জ যাওয়ার পথে রাস্তায় সুবিধামতো জায়গায় গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। কাদের খান বগুড়ার রহমাননগরের বাড়ি থেকে বের হয়ে বগুড়া রেলগেট থেকে কিনে নেন দুইটি হাতুড়ি। পরিকল্পনা হয়,পথে সুবিধা মতো জায়গায় এমপি লিটনের গাড়িকে পিছন থেকে কাদের খানের গাড়ি ধাক্কা দেবে। এতে লিটনের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে আসবে এবং এমপি লিটন গ্লাস খুলে দেখা মাত্রই কাদের খান নিজেই গুলি করে হত্যা করবে লিটনকে। আর যদি লিটন গ্লাস না খোলেন, তাহলে কাদের খানের সাথে থাকা খুনিদের মধ্য একজন হাতুড়ি দিয়ে গ্লাস ভাঙবে আর কাদের খান লিটনকে গুলি করবে। কিন্তু সেদিন লিটন ঢাকা থেকে সুন্দরগঞ্জের উদ্দেশে রওনা না করায় তাদের মিশন ভেস্তে যায়। তারপর দ্বিতীয়বারের মতো হত্যার পরিকল্পনা করা হয় সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা দলীয় কার্যালয়ে। গুলি করে হত্যার দায়িত্ব নেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি চন্দন কুমারের ভগ্নিপতি কারাগারে মারা যাওয়া সুবল কসাই। পরিকল্পনা হয়,দলীয় অফিসের টিনসেট ওয়াশরুমে লিটন যখন প্রস্রাব করতে যাবেন,ঠিক তখনই টিন ফুটো করে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করবে সুবল কসাই। আর সেখানে সুবলকে সহযোগিতা করবে ছয়জন। কিন্তু খুনি সুবল কসাই সহ তার সহযোগীরা সেদিন কাদের খানের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবী করায় সেটিও ব্যর্থ হয়। এরপর ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর হত্যার উদ্দেশ্য খুনি মেহেদি, শাহীন ও রানা এমপি লিটনের বাড়িতে অবস্থান করলেও পুলিশের উপস্থিতির কারণে ভেস্তে যায় তৃতীয়বারের মতো লিটন হত্যা মিশন।
পরদিন ৩১ ডিসেম্বর বেলা ১২ টার দিকে বগুড়া থেকে রওনা হন কাদের খান। বেলা আড়াইটার দিকে পৌঁছেন তার সুন্দরগঞ্জের ছাপড়হাটির খান পাড়ার বাড়িতে। ইতোমধ্য চন্দন কুমার রায় মুঠোফোনে কাদের খানের কাছে এমপি লিটনের সর্বশেষ অবস্থান জানাচ্ছিলো। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে খাদের খান নিজে মোটরসাইকেলটির নম্বর প্লেটটি লাল কছটেপ দিয়ে ঢেকে নিজে স্ট্রাট দিয়ে খুনি মেহেদিকে দেন। মাঝে উঠতে বলেন রানাকে আর পিছনে শাহীনকে। এসময় কাদেরের লাইসেন্সকৃত পিস্তলটি দেন মেহেদিকে আর শাহীন ও রানাকে দেন দুইটি কামারি আগ্নেয়াস্ত্র। খুনিদের বিদায় দেওয়ার সময় কাদের খান বলেছিলেন,আজকে উপযুক্ত সময়। এমপি লিটন বাড়িতে একা অবস্থান করছে। অবশ্যই অপারেশন সফল করে ফিরে আসবে। এরপর পথে রানার ফোনে কল দেন চন্দন কুমার। লোকেশন জানতে কথা বলেন মেহেদির সাথেও। মেহেদীকে বলা হয়, লিটন বাড়িতে একা আছে,কোনো সমস্যা নাই। সন্ধা ৫টা ২০ মিনিটের দিকে মেহেদি তার বাইকটি থামায় লিটনের বাড়ির পাশে বটগাছের নিচে। সেখানে দেখতে পায় লিটনের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি মুছছে। আর লিটন যে ড্রয়িং রুমে আছে সেই রুমের দরজার সামনে লিটনের সমন্ধি বেতার দাঁড়িয়ে আছে। মেহেদি বেতারকে জিজ্ঞাসা করে এমপি স্যার আছে নাকি? স্যারের সাথে দেখা করতে আমরা আসছি। এসময় বেতার লিটনের কাছে অনুমতি নিয়ে তাদেরকে ভিতরে যেতে দিয়ে বেতার বাড়ির ভিতরে চলে যান। রানা ও শাহীন ভিতরে গিয়ে লিটনকে সালাম দিলে লিটন তাদেরকে সোফায় বসতে বলেন। আর লিটন বালিশে হেলান দিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে থাকেন। রানা ও শাহীন কাদের খানের শিখিয়ে দেওয়া গল্প “আমরা যুবলীগ করি,আমরা একটা ক্লাব করবো,আমাদের সাহায্য করতে হবে আপনার” দিয়ে শুরু করেন। আর মেহেদি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় ড্রাইভার বাড়ির ভিতরে গেলে মেহেদি রুমে ঢুকেই লিটনকে গুলি ছোড়ে। এসময় দুইটি গুলি লিটনের বুকের বাম পাশে,বাম হাতের তালুতে দুইটি এবং পিটের ডান পাশে একটিসহ মোট পাঁচটি গুলি করেন মেহেদি। তখনও মেহেদির মাথায় কালো রংয়ের হেলমেট ছিল। গুলি শেষে মেহেদি দৌঁড়ে বটগাছের নিচে রাখা মোটরসাইকেল স্ট্রাট দিলে রানা ও শাহীন দৌঁড়ে এসে বাইকে উঠে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার প্রাক্কালে শাহীনের মাথায় থাকা একটি কালো রংয়ের ক্যাপটি মাটিতে পড়ে যায়। ক্যাপটি উঠানোর চেষ্টা করলে লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি,তার বড় ভাই সৈয়দ বেতারুল আহসান বেতার সহ গাড়ির ড্রাইভার ছুটে আসলে রানা ও শাহীনের কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে লিটন মোড় হয়ে রক্ষিপুর দিয়ে ছাপড়হাটির খান পাড়ার বাড়িতে এসে পৌঁছায় এবং কাদের খানকে অপারেসন সফল হয়েছে বলে জানায়। এভাবেই চতুর্থ দফা মিশনে লিটনকে তার নিজ বাড়িতে এলোপাথাড়িভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। পরে লিটনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে সাড়ে সাতটার দিকে লিটন মৃত্যেুর কোলে ঢলে পড়েন।
পরদিন নিহত লিটনের বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলি বাদী হয়ে কয়েকজন অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর জড়িতদের ধরতে শুরু হয় পুলিশের অভিযান। সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতার করা হয় জামায়াত-বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ২৩ জন নেতাকর্মীকে। তাদের দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেও এমপি লিটন হত্যার কোনো কুল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
প্রায় আড়াই মাস ধরে অন্ধকারে হত্যাকারীদের খুঁজতে থাকে পুলিশ। এরপর শাহীনের ফেলে যাওয়া মাথার কালো রংয়ের ক্যাপ ও একটি ম্যাগাজিনের সূত্র ধরে এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী ও পরিকল্পনাকারী,অর্থ ও অস্ত্র যোগানদাতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডা. মো. আ. কাদের খান ও কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া খুনিদের সহ সহযোগীদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
এরপর ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করে পুলিশ। প্রায় তিন বছরের মাথায় ক্ষমতাসীন দলের এমপি চাঞ্চল্যকর লিটন হত্যা মামলার রায় গত ২৮ নভেম্বর ঘোষণা করা হয়। ১২০ পাতার রায়ে সাতজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালতের বিচারক দিলীপ কুমার ভৌমিক।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত ডা. মো. আব্দুল কাদের খান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদি হাসান ওরফে মেহেদি, শাহিন মিয়া ওরফে শান্ত, আনোয়ারুল ইসলাম ওরফে রানা, গাড়ির ড্রাইভার আব্দুল হান্নান,পিএস এজেএম শামসুজ্জোহা ওরফে জোহা, শ্রী সবল চন্দ্র রায় ওরফে কসাই এবং চন্দন কুমার রায়। এরমধ্য সুবল কসাই কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় মারা যায়। অপর আসামি চন্দন কুমার রায় পলাতক রয়েছেন।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন