ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন ছিলেন দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের মধ্যে ব্যতিক্রম একজন মানুষ। দেশের চিন্তা, দশের চিন্তায় সবসময় বিভোর থাকতেন। দেশ ও মানবতার স্বার্থই ছিল তার আরধ্য।
বলিষ্ঠ কণ্ঠের অধিকারী হেমায়েত উদ্দিন অনলবর্ষী বক্তৃতা করতেন। জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠতেন ছাত্রজীবন থেকেই। তার বহু কালজয়ী বক্তৃতা আমাদের জাতীয় সম্পদ হয়ে থাকবে। দেশের জাতীয় রাজনীতিতে তিনি বেঁচে থাকবেন একজন অনুকরণীয় জননেতা নেতা হয়ে।
অত্যন্ত মেধাবী হেমায়েত উদ্দিনের লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয় জন্মস্থান বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের একটি মাদরাসায়। বাবা মাওলানা আবদুল আলির প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ভর্তি হন খুলনার একটি হাফেজি মাদরাসায়।
সেখান থেকে পবিত্র কোরআনের হেফজ শেষ করেন এবং পরবর্তিতে ঢাকার মাদরাসা-ই-আলিয়া থেকে কামিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন।
কর্মজীবনে এটিএম হেমায়েত উদ্দিন মালিবাগের আবুজর গিফারী কলেজ এবং রামপুরার একরামুন্নেসা ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। পশ্চিম রাজাবাজার জামে মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ৪২ বছর। এলাকাবাসীর কাছে তিনি বড় হুজুর বলে পরিচিত ছিলেন।
শিক্ষানুরাগী হাফেজ হেমায়েত উদ্দিন ঢাকায় দুটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজাবাজার হাফিজিয়া মাদরাসা এবং মাতুয়াইল কারিম মাদরাসা পরিচালনা করতেন।
ছাত্রজীবন থেকেই মাওলানা হেমায়েত উদ্দিনের মধ্যে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের অধিকার বাস্তবায়ন এবং শিক্ষামান উন্নয়নের জন্য তরুন বয়স থেকেই কাজ করেছেন।
আশির দশকে জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া নামক একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। টানা তিন সেশনের সভাপতি ছিলেন ওই সংগঠনের। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।
হযরত হাফেজ্জি হুজুরের (রহ.) হাত ধরে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে অভিষেক হলেও এটিএম হেমায়েত উদ্দিন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শুরু থেকে। তিনি এই সংগঠনের ঢাকা মহানগর সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠতা আমির মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিমের (রহ.) অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর এটিএম হেমায়েত উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী একজন জননেতা হিসেবে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নেন যুবক বয়সেই।
দেশের সব জাতীয় রাজনীতিক এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি উদার এবং গণমুখী রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। একবার জামায়াত ইস্যুতে দলীয় আমিরের সাথে মতনৈক্য হলে তিনি ইসলামি আন্দোলন ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানে নিজের মত প্রত্যাহার করে ফিরে আসেন।
মাতবতাবাদী হেমায়েত উদ্দিন শুধুমাত্র রাজনীতি নিয়ে পড়ে থাকতেন না। দেশের বিভিন্ন সময়ের প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ মানুষের সুবিধা অসুবিধায় ঝাপিয়ে পড়তেন। ত্রাণের বস্তা নিজের মাথায় নিয়ে ছুটে যেতেন অসহায় মানুষের দারে দারে।
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তখন শাসকগোষ্ঠি দ্বারা বারবার কারা নির্যাতনের শিকার হন এটিএম হেমায়েত।
ঢাকাবাসীর অধিকার আদায়ে অধ্যাপক হেমায়েত উদ্দিন সব সময় সোচ্চার ছিলেন। সকল আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। ২০০২ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করে তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন।
ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী হেমায়েত উদ্দিন শিক্ষা এবং শিশুদের বেড়ে উঠার জন্য অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির পক্ষে সব সময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শিশুদের জন্য খেলার মাঠ এবং নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে গোটা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। একজন সত্যিকারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
অধ্যাপক হেমায়েত উদ্দিন বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন। দেশের ইসলামপন্থীদের মধ্যে একটি টেকসই ঐক্য গড়ে তুলতে তার অক্লান্ত পরিশ্রম উদাহরণ হয়ে থাকবে বহুদিন।
সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হেমায়েত উদ্দিন দেশের স্বার্থ এবং দেশের মানুষের স্বার্থে সব সময় কথা বলতেন। বিশেষ করে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার মোহ এবং বিদেশনীতির তীব্র সমালোচনা করতেন। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে ছিলেন আপোষহীন।
খেটে খাওয়া, মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতেন। দেশের কৃষক মজুর জেলে তাতীসহ সব শ্রেণী পেশার মানুষকে আপন করে বুকে টেনে নিতেন। তার মত জনবান্ধব নেতা দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিতে খুব একটা দেখা যায় না।
অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। দেশের শাসন পদ্ধতির আমুল পরিবর্তন প্রত্যাশা করতেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নের আগেই তাকে চিরবিদায় নিতে হয়। গত ১১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে মাত্র ৬৪ বছর বয়েসে পরিসমাপ্তি হয় তার সংগ্রামী ইহলোক।
আমরা এটিএম হেমায়েত উদ্দিনের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন