বুয়েটের নির্যাতন কক্ষের অমিত সাহাকে নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। তাকে কেন হত্যাকান্ডের মামলা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে এনিয়ে চলছে নানান জল্পনা কল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ অনেকেই দিনভর এনিয়ে সমালোচনায় ছিলেন মুখর। অমিত কেন মামলার আসামী থেকে বাদ পরছে এনিয়ে তুমুল বিতর্ক এখন বুয়েটসহ সারা দেশে। অনেকেই মন্তব্য করে বলেছেন কোন জিনিষকে রক্ষা করতে ও কাকে খুশি করতে অমিতকে রাখা হচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
বুয়েটের টর্চার সেল বলে খ্যাত শেরে বাংলা হলের ২১১ কক্ষে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই অমিতের ব্যাপারে বক্তব্য রেখেছেন। বলেছেন সে পরে ঢুকেও আবরারকে ফেসবুকের স্ট্যাস্টাস নিয়ে নানান আকাঁ বাকা প্রশ্ন করেছেন। পিটিয়েছেন ইচ্ছামত। ওই রুমে থাকা একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেছেন অমিত একটু দেরী করে ফোন পেয়েই আসেন। তিনি এসে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেছেন আবরারকে। বলেছেন তার লেখালেখির বিষয়ে অনেক কথা। এক পর্যায়ে তিনি স্ট্যাম্প নিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছেন।
আলোচিত সেই ছাত্রলীগ নেতারা
বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু বলেন, আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন বুয়েট ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুজতবা রাফিদ, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল এবং উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা।
জেরা করে শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পর চতুর্থ বর্ষের ভাইদের খবর দেয়া হয় বলে জানান বিটু। খবর পেয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার সেখানে যান।
হলের যে কক্ষে আবরারকে পেটানো হয়, সেই কক্ষে চার শিক্ষার্থী থাকেন। তাঁরা হলেন-বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপদপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ।
‘একপর্যায়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি। এরপর হয়তো ওরা মারধর করে থাকতে পারে। পরে রাত তিনটার দিকে শুনি আবরার মারা গেছে,’ বলেন বুয়েট ছাত্রলীগের এই সহ-সম্পাদক। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। এই ঘটনা নিয়ে নানান ভাবে ব্যস্ত ছিলেন বিটু।
পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ-ডিবির (ঢাকা দক্ষিণ) এডিসি রাজীব আল মাসুদ বলেছেন, ‘বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র অমিত সাহাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়নি।
তদন্ত সাপেক্ষে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’ আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, আবরার হত্যার ঘটনায় আটক ১০ জন তাদের সম্পৃক্ততার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে তারা জানিয়েছে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল না। মারধর করতে গিয়ে আবরার মারা গেছে। তারপরও ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এই মামলা থেকে রহস্যজনক ভাবে বাদ পড়েছে এই হত্যাকান্ডের অন্যতম অভিযুক্ত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক উপ সম্পাদক অমিত সাহা। খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে শেরে- বাংলা হলের ২০১১ নং রুমে থাকতো যে রুমে আবরারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবরারের একাধিক সহপাঠি অভিযোগ করে বলেন, এই হত্যাকান্ডের সাথে আমিত সাহা সরাসরি সম্পৃক্ত কিন্ত রহস্যজনকভাবে মামলার এজহার থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন বড় বড় কর্মকর্তার আত্নীয়। বিভিন্ন্য পত্র- পত্রিকা ও টেলিভিশনেও তার সম্পৃক্ততার খবর প্রচার করা হলেও তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হয় নি। অনতিবিলম্বে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে বলে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন তাকে নিয়ে এত কিছু করার মানে কি? এসব কি চলছে তাকে নিয়ে।
অপরদিকে মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়েছে মেহেদী হাসান রাসেল (২৪) কে। তিনি ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক। তার বাবার নাম রুহুল আমিন, গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সালথা থানাধীন সূর্যদিয়া রাংগারদিয়ায়।
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ৩০১২ নম্বর রুমের শিক্ষার্থী। দুই নম্বর আ’সামি করা হয়েছে মুহতাসিম ফুয়াদ(২৩) কে। তিনি ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সহ-সভাপতি। তার বাবার নাম আবু তাহের। গ্রামের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়ার দৌলতপুর লাঙ্গলমোড়ায়। একই হলের ২০১০ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী।
মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয়েছে অনিক সরকার (২২) কে। ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। তার বাবার নাম আনোয়ার হোসেন। গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর মোহনপুর থানাধীন বড়ইকুড়িতে। একই হলের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
এ মামলার চার নম্বর আসামি ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (২২)। তার বাবার নাম মাকসুদ আলী। গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর পবা থা’নাধীন চৌমহানীর কাপাসিয়ায়। একই হলের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
পাঁচ নম্বর আ’সামি- ইফতি মোশারফ সকাল (২১)। ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার উপ সমাজসেবা সম্পাদক। বাবার নাম ফকির মোশারফ হোসেন। স্থায়ী ঠিকানা রাজবাড়ী সদরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৯৫ নম্বর বাসা। একই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষের ও বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচ।
মা’মলার ছয় নম্বর আ’সামি মনিরুজ্জামান মনির (২১)। ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সাহিত্য সম্পাদক। বাবার নাম মাহতাব আলী। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থা’নাধীন ভাঙ্গারীপাড়ায়। একই হলের পানি সম্পদ বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। সাত নম্বর আ’সামি- মেফতাহুল ইস’লাম জিয়ন (২২)।
ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার ক্রীড়া সম্পাদক। বাবার নাম শহিদুল ইস’লাম। গ্রামের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর থা’নাধীন শঠিবাড়ী এলাকায়। একই হলের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
৮ নম্বর আ’সামি হলো মাজেদুল ইস’লাম (২১)। সাংগঠনিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। ঠিকানাও অ’জ্ঞাত। শেরেবাংলা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও ম্যাটেরিয়াল অ্যান্ড ম্যাটার্লজিক্যাল বিভাগের ১৭তম ব্যাচ
৯ নম্বর আ’সামি মোজাহিদুল ওরফে মোজাহিদুর রহমান (২১)। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সদস্য। ঠিকানা অ’জ্ঞাত। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ৩০৩ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী ও ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচ। ১০ নম্বর আ’সামি হলো- তানভীর আহম্মেদ (২১)। সাংগঠনিক পরিচয় ও ঠিকানা অ’জ্ঞাত। একই হলের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
১১ নম্বর আ’সামি হলো হোসেন মোহাম্ম’দ তোহা (২০), সাংগঠনিক পরিচয় ও ঠিকানা অ’জ্ঞাত। একই হলের ২১১ নম্বর কক্ষের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১২ নম্বর আ’সামি হলো- জিসান (২১), সাংগঠনিক পরিচয় ও ঠিকানা অ’জ্ঞাত। একই হলের ৩০৩ নম্বর কক্ষের ছাত্র ও ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।
প্রসঙ্গত, গত ৬ অক্টোবর দিবাগত মধ্যরাতে বুয়েটের সাধারণ ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফাহাদকে শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সোমবার (৭ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, বুয়েটের শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থী, সিসিটিভি ফুটেজ ও আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে।
সূত্র জানায়, ফাহাদকে জেরা ও পেটানোর সময় হলের ওই কক্ষে অমিত সাহা, মুজতাবা রাফিদ, ইফতি মোশারফ ওরফে সকালসহ তৃতীয় বর্ষের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই কক্ষে এসে দ্বিতীয় দফায় ফাহাদকে পেটান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক ও নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একই বর্ষের মেফতাহুল ইসলাম জিয়নসহ কয়েকজন। তারা সবাই মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারী।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে সোমবার সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ্। এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ মোট ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামলাটি এখন রয়েছে ডিবিতে।
ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন