টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দল ও সরকার পৃথক করার পরিকল্পনা থাকলেও কার্যত হয়নি। বরং সরকারে ব্যস্ত আওয়ামী লীগের লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত। দলের নতুন সম্মেলনের তারিখ পড়ে গেলেও শাখা পর্যায়ে সম্মেলন, কমিটি গঠন, সাংগঠনিক কর্মসূচিতে নেই আগ্রহ। একের পর এক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও বাস্তবায়নে অনীহা, আদর্শের পরিবর্তে মাইম্যান প্রাধান্যসহ নানমুখি সংকটে দলটি।
এতে মনে হচ্ছে, সরকারে দক্ষ আওয়ামী লীগ, দলে তার উল্টো। সরকার পরিচালনা নানামুখী কর্মব্যস্তায় দলের অবস্থা খুবই নাজুক আওয়ামী লীগের। এই মেয়াদে মাত্র (২০১৬-২০১৯) একটি জেলায় সম্মেলন করেছে দলটি। অথচ আগের মেয়াদে (২০১২-২০১৬) বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেও ৫৮টি জেলায় সম্মেলন হয়েছে। দীর্ঘ সময় সম্মেলন ও কমিটি না হওয়ায় জেলা ও উপজেলাগুলোতে দলীয় শৃঙ্খলা তো নেই-ই, বিশৃঙ্খলাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সারাদেশে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। নৌকার প্রার্থীর চেয়ে ‘বিদ্রোহী’রা জয় পেয়েছে বেশি।
আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে, এই তথ্যে ঘুম হারাম আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের। এটি বিএনপি ভীতির জন্য নয়, বরং দলের বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের টেনশনে। ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী কমাতে ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহীদের ‘শোকজ’সহ নানা লোক দেখানো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যদিও এটি বুমেরাং হবে। কারণ এ নিয়েও উভয় সংকটে আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে দলটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক পরিবর্তন ডটকমের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় বলেছেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করে জিতেছেন, তাদের নিশ্চয় ভোটার ও কর্মী আছে। নিজস্ব একটা সাংগঠনিক শক্তিও আছে। ভোটের মাঠে সে যেমন শক্তিশালী, নিশ্চয় কর্মীদের মধ্যেও। সম্মেলন করতে গেলে এটি আরও স্পষ্ট হবে। এখন সমস্যা হলো; তার জনপ্রিয়তার কারণে কাউন্সিলররা ভোট দেবে তাকে, আমরা কীভাবে নৌকার বিরোধিতাকারীকে দিয়ে কমিটি দিবো? আবার সে আওয়ামী লীগের লোক, জনপ্রিয়ও। এটা তো উভয় সংকট।’
এমন কেন হবে? বা এর সমাধান কী? জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলছেন, ‘দল ক্ষমতায় থাকলে এমন সংকট দেখা দিতে পারে। তবে আদর্শিক ভিত ঠিক থাকলে এগুলোর সমাধানও সম্ভব। কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক নেতা জনগণ ও কর্মীদের থেকে দূরে। এ যায়গাটা অন্য কেউ দখলে নিয়েছে। সে হয়তো দ্বিতীয় সারির নেতা, কিন্তু জনগণ ও কর্মীদের মন জয় করতে পেরেছে। আবার অনেক যায়গায় দলীয় গ্রুপিং আছে, সেখানে যার গ্রুপ শক্তিশালী সে বাজিমাত করে। অথবা এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতোদের দূরত্ব আছে। এসবের সমাধান হয় দলের নিয়মিত সম্মেলন, কমিটি গঠন ও কর্মসূচিতে সবার সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে। আমরা সেটাই করতে যাচ্ছি।’
২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর জাতীয় সম্মেলন হয়েছে আওয়ামী লীগের। এতে শেখ হাসিনাকে ফের সভাপতি ও ওবায়দুল কাদেরকে নতুনভাবে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর পর এই কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়েছে খুব কম সময়ের মধ্যেই, কিন্তু ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে শুধু একটিতে সম্মেলন হয়েছে। সেটি হলো মৌলভীবাজার জেলা; ২০১৭ সালে ২৮ অক্টোবর সম্মেলন হয়।
এটা কেনো? জবাব খুঁজতে গেলে স্বভাবত ওঠে আসে সরকারে তাদের ব্যস্ততা, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা, দলের সাধারণ সম্পাদক চরম অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন থাকাসহ নানা কারণ। যত কারণই থাকুক না কেনো এটি দিনশেষে এটি নতুন সাধারণ সম্পাদকের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে বলে মনে করছেন দলের অনেকে। তাদের মতে, এর চেয়ে বড় সংকট থাকলে গত সেশনে ৫৮টি জেলার সম্মেলন হয়েছে কীভাবে?
অবশ্য সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব শাখা সম্মেলন করার সময় বেঁধে দিয়েছেন। ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তার প্রস্তুতি হিসেবে সম্মেলন আয়োজনে প্রস্তাবিত উপ কমিটিও করা হয়েছে।
এ বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ‘ডিসেম্বরের ২০ ও ২১ তারিখ আমাদের জাতীয় কাউন্সিল। আমরা ১০ ডিসেম্বরের আগে সব শাখাগুলোর সম্মেলন করে সম্মেলনের প্রস্তুতি নেবো। ইতিমধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৮টি টিমে ভাগ করে কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন ইউনিটে সফর করবো এবং জাতীয় সম্মেলনের জন্য দলকে প্রস্তুত করবো।’
দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রাজ্জাক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘সরকার ও দল দুটোই ভারসাম্য করার চেষ্টা আমরা করছি। সরকারে থেকে মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ইতিমধ্যে আমরা সক্ষম হয়েছি। আমাদের উন্নয়নে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, সারাবিশ্ব স্বীকৃতি দিচ্ছে। দলেও আমরা আমাদের কাজের গতি ধরে রাখতে যথা সময়ে সম্মেলন করছি। শাখা সম্মেলন করেই আমরা জাতীয় সম্মেলন করবো। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের তারিখ হয়ে গেছে। এটা অনেক বড় বিষয়। আমাদের দলের কর্মীদের পাশাপাশি সব মানুষের জন্যও এটি সুখবর। সবাই জানে আওয়ামী লীগই একমাত্র গণতন্ত্রের চর্চাটা করে। ঠিক সময়ে সম্মেলন হয়।’
কমিটি গঠন নিয়ে নিজেদের ব্যর্থতার বিষয়ে জানালে তিনি বলেন, ‘এটি নিয়ে আমাদের নেত্রীর নির্দেশনা আছে; সে অনুযায়ী আমরা ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি সম্মেলনগুলো করবো।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন