বহুল প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচনের ৬ মাস পূর্ণ হলো আজ ১১ সেপ্টেম্বর। ডাকসু নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সংশ্নিষ্ট সবার মধ্যে যে ব্যাপক প্রত্যাশা ছিল, গুটিকয়েক প্রোগ্রাম ছাড়া ক্যাম্পাসে কার্যত মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রত্যাশা-প্রাপ্তির খতিয়ানে অপ্রাপ্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডাকসুর ভিপির সঙ্গে জিএস-এজিএসের সমন্বয়হীনতা, অসহযোগিতা ও বৈরী সম্পর্ক।
দীর্ঘ ২৮ বছরের অচলাবস্থা ভেঙে গত ১১ মার্চের নির্বাচনের মাধ্যমে সচল হয় ডাকসু।একসময় দেশের 'সেকেন্ড পার্লামেন্ট' হিসেবে খ্যাত এই ডাকসুর কাছে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ছিল-বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট নিরসন, গণরুম-গেস্টরুম প্রথা উচ্ছেদ, অছাত্র বহিরাগত বিতাড়ন, ক্যান্টিনে খাবারের মান বৃদ্ধি, পরিবহন সমস্যার সমাধান, ক্যাম্পাসে গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজ অটোমেশনের আওতায় আনয়ন, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল, লাইব্রেরি সংকট নিরসন ইত্যাদি সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। নির্বাচনী ইশতেহারেও এসব মৌলিক সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার করেন প্রার্থীরা।
ডাকসু যা করেছে- ডাকসুর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের নেওয়া দৃশ্যমান উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে-কয়েকটি বিভাগের উন্নয়ন ফি কমানো, হলের ফি কমানো, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলার আয়োজন, সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ, ছাত্রী হলসহ বিভিন্ন রুটে পরিবহন বৃদ্ধি, লাইব্রেরি খোলার সময়সীমা দুই ঘণ্টা বাড়ানো। যদিও এটুকুতেই সন্তুষ্ট নন শিক্ষার্থীরা। আর এসব কাজও বিচ্ছিন্নভাবে ডাকসুর কিছু সদস্য করেছেন। সম্মিলিতভাবে ডাকসুর কোনো পদক্ষেপ এখনও হয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, নির্বাচনের ৬ মাস পার হলেও নির্বাচিত নেতারা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। নির্বাচনে প্রার্থীরা যে পরিমাণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার অনেকাংশই পূরণে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। ২৮ বছরে সমস্যার পাহাড় জমেছিল। আর এসব সমস্যা সমাধানে কোনো প্রার্থীই দৃশ্যমান কোনো কাজ করেননি।
‘ব্যর্থ’ হলেও খরচ হচ্ছে অর্থ:
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণে ‘ব্যর্থ’ হলেও এ পর্যন্ত ডাকসুর বাজেটের এক-পঞ্চমাংশের কিছু বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। ডাকসুর সর্বশেষ সভায় পাস হওয়া বাজেটের (১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা) প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।
বাজেটে অভিষেক অনুষ্ঠানের জন্য ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও অনুষ্ঠানটি এখনো হয়নি।১১ মার্চ নির্বাচনের পর ২৩ মার্চ ও ৩০ মে দুটি সভা হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ডাকসুর অভ্যন্তরীণ কোনো সভা হয়নি। ২৩ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণ ও প্রথম সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাঁকজমকপূর্ণ অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজন করার কথা থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি ডাকসু নেতারা।
ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর এসব অভিযোগ স্বীকার করে ক্যাম্পাসলাইভকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই নয়, গোটা দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু নানা কারণে এসব প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছিনা। এর মূল কারণ- একটি পক্ষ চাচ্ছেনা ডাকসু কার্যকর ও সক্রিয় হোক। এতে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে। আমি ভিপি হিসেবে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে যখনই কোনো হলে যাই, তখনই হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। কোন প্রোগ্রাম হাতে নিলে জিএস, এজিএসের অসহযোগিতায় পণ্ড হয় সেই উদ্যোগ।
আপনারা জানেন গত জুলাইয়ে ঢাকা ডাকসুর পক্ষ থেকে ‘অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন অন সাইবার সেইফটি অ্যান্ড ৯৯৯’ শীর্ষক সপ্তাহব্যাপী একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। উদ্যোগটি নিয়েছিলেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। ১৬ জুলাই থেকে কর্মশালাটি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেননি। কারণ, তিনি সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেল থেকে নির্বাচিত।
তিনি বলেন, ডাকসুর পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সংশ্নিষ্ট বিষয় নিয়ে বেশকিছু সেমিনার এবং সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের যে মৌলিক চাহিদা নিয়ে এখন পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারিনি। এখনো গণরুম-গেস্টরুম কালচার বিদ্যমান।
বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের যে প্রধান সমস্যা আবাসিক সংকট নিরসন করা এবং হল থেকে অছাত্র-বহিরাগত বিতাড়ন করে বৈধ শিক্ষার্থীদের সিট দেওয়ার বিষয়টি কার্যকর হয়নি। এক্ষেত্রে প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং ছাত্রলীগের প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব সম্ভব হয়নি। তবে তিনি মনে করেন শিক্ষার্থীরা যদি স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে, ডাকসুকে কার্যকর করা সম্ভব।
এদিকে ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানীর সাথে যোগাযোগ করতে না পারলেও এসব ব্যর্থতার বিষয়ে একমত নন ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন।
ক্যাম্পাসলাইভকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সফলতা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। এখানে সকল ছাত্র সংগঠনের সহবস্থান আছে। সবাই যার যার মতো করে কর্মসূচি পালন করতে পারছে। আমি বলতে পারি গত তিন দশকে, ৯০ এর পরে গত ৬ মাসে ক্যাম্পাসে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় ছিল। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি গণতন্ত্রের জয়ে ডাকসু সফল।
ক্যাম্পাসের মৌলিক সমস্যার সমাধান নিয়ে তিনি বলেন, এসব সমস্যার সমাধান সময় সাধ্য ব্যাপার। আমাদের মূল যে সমস্যা আবাসিক সংকট, এর জন্য আমাদের আরও হল লাগবে। এ ব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি। ক্যান্টিনের খাবারের মান আগের চেয়ে ভালো। পরিবহন সমস্যার সমাধানে ডিইউ চক্কর 'জো-বাইক'-এর উদ্বোধন খুব শিগগির করা হবে।
এছাড়া যখনই শিক্ষার্থীরা কোনো প্রয়োজন নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে, তাৎক্ষণিকভাবেই সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছি। সব মিলিয়ে ডাকসু নির্বাচন হওয়াতে ক্যাম্পাসে আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনের ৬ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও ডাকসুর কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন ডাকসুর অনেক সদস্য। কয়েকজন সদস্য এবং সম্পাদকের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে আশানুরূপ কাজ করা সম্ভব হয়নি। তন্মধ্যে ৬ মাসে অধিকাংশ সময় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা, নিয়মিত ডাকসুর সাধারণ সভা না হওয়া, ভিপি-জিএস ও এজিএসের সমন্বয়হীনতা, মতাদর্শগত ভিন্নতা। তবে সামনে দিনগুলোতে আরও ভালো কিছু করতে চান বলে জানান তাঁরা।
ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন