বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন বছর ক্ষমতায় রয়েছে। টানা তৃতীয় এবং চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা রদবদল করে দেশ পরিচালনা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে এর পেছনে মূল যুক্তি, একজন টানা দায়িত্ব পালন করলে তার ক্লান্তি ও আড়ষ্টতা এসে যায়। সে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মন্ত্রিসভায় রদবদল করে নতুন মন্ত্রীরা এসে সরকারকে কিছু দেবেন, নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করবেন এবং মন্ত্রণালয়ে কাজে গতি পাবে এমন ভাবনা থেকেই মন্ত্রিসভায় বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুন মন্ত্রী করা হয় বলে সরকার এবং রাজনৈতিক সূত্রগুলো মনে করে। এবার আওয়ামী লীগ সভাপতি হয়তো এরকম বিবেচনা থেকেই নতুন মন্ত্রিসভার রদবদল করেছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের মতো একটা বিশাল রাজনৈতিক দলের মাত্র কয়েকজন টানা মন্ত্রী থাকলে দলের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যরা মনে করে যে তারা দলে অপাংক্তেও। এরকম বিবেচনা থেকেই মন্ত্রিসভার রদবদল করলে মন্ত্রীদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়ে এবং অনেকেই দলের প্রতি নিবেদিত হয় যেন তারাও একদিন মন্ত্রী হতে পারেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই এরকম মন্ত্রিসভার রদবদল হয়। এবার ভারতে মন্ত্রিসভা দ্বিতীয়বারের মতো এসে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। কিন্তু রদবদল করলে কি হবে? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সুষমা স্বরাজ, তাঁর বদলে তারই অধিনস্থ সচিব জয়শঙ্কর শুভ্রামনিয়মকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি প্রথম পরামর্শ গ্রহণ করেছেন সুষমা স্বরাজের। একই রকমভাবে ইন্ধিরা গান্ধীর পর ভারতের প্রথম নারী অর্থমন্ত্রীও দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সাবেক অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলির কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছেন। ভারতের রাজনীতিতে সাবেকদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়ার রীতি থাকলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে যে, টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার সাবেকদেরকেই তাদের প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। আগের আমল থেকে সবকিছু উলট পালট করে দেওয়ার একটা প্রচ্ছন্ন মানষিকতা তাদের মধ্যে রয়েছে। যদিও সরকার বারবার বলছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কথা বলা হলেও মন্ত্রণালয়গুলোতে তাদের প্রাক্তন মন্ত্রীর নীতি এবং কৌশলের সমালোচনা প্রায় প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। এর ফলে সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। অনেকক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে, সাবেকরা মনে হয় বর্তমান মন্ত্রীদের শত্রু কিংবা প্রতিপক্ষ।
সাবেক মন্ত্রীদের অনেক সময় বিরোধী দলের নেতার মতোও ট্রিট করা হচ্ছে। যেটা নিয়ে সরকারের মধ্যেই নানা রকম গুঞ্জন এবং অস্বস্তি স্পষ্টতই চোখে পড়েছে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখে বলেছেন, তিনি রাত ৯টা পর্যন্ত অফিস করেন। কিন্তু আগে এই মন্ত্রণালয়ে দুপুর ২টার মধ্যেই খালি হয়ে যেত।
এধরণের বক্তব্যে তিনি স্পষ্টত সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফের সমালোচনা করেছেন। যে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেন হয়তো এত বেশি কাজ করতেন না কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ যেমন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন বর্তমান মন্ত্রী তাজুল ইসলামও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী। কাজেই এই সমালোচনায় কে আক্রান্ত হলো সাবেক মন্ত্রী না আওয়ামী লীগ সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। একইভাবে দেখা যাচ্ছে যে সাম্প্রতিক ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সাবেক দুই মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং আফম রুহুল হক বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলেও হাসপাতালের কর্মকর্তা বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এ নিয়ে ছিল চাপা উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা। কারণ সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে থাকলে পাছে কি জানি কি হয়। এরকম একটি অনুভব তাদের মধ্যে ছিল। এরকম কর্মসূচি গ্রহণ করেই তাঁদেরকে আর দেখা যায়নি। অথচ নাসিম যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন জাহিদ মালিক। কাজেই এটা খুবই শোভন এবং সঙ্গত হত যে, সাবেক মন্ত্রীদের ডেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাহিদ মালিক পরামর্শ চাইতেই পারতেন। কিন্তু তেমনটি হয়নি। সাবেক রেলমন্ত্রী ছিলেন মুজিবুর রহমান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন যে, রেলের যে বিগত দিনের অসঙ্গতিগুলো তিনি পাল্টে ফেলবেন। কিন্তু বিগত দশ বছর তো আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিল। তাহলে আওয়ামী লীগই কি অসঙ্গতি করেছে? এমনকি দেখা যাচ্ছে বিমানের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনিও একই সুরে বলেছেন যে, বিমানের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে এবং অতীতে যে সমস্ত অন্যায়, দুর্নীতি রয়েছে তা বন্ধ করতে হবে। তাহলে অতীতে বিমানের দুর্নীতি কে করেছে? আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী করেছে? নাকি অন্যকেউ করেছে?
টানা ক্ষমতায় থাকায় যেমন সুবিধা আছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় তেমনি অসুবিধাও আছে। প্রতিপক্ষ বানানো যায় না কাউকে, দোষারোপের সংস্কৃতির যে রাজনীতি বাংলাদেশে দৃঢ়ভাবে পতিত হয়ে আছে সেক্ষেত্রে অতীতের মন্ত্রিকে বলির পাঠা বানানোই খুব সহজ। ৯১ সাল থেকে যখন আওয়ামী লীগ বিএনপির ক্ষমতার পালাবদল হতো তখন এক সরকার অন্যসরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাতো কিন্তু এখন বাস্তবতা তেমন নয়। এখন মন্ত্রীর পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু সরকারের নয়। এই বোধটুকু মন্ত্রীদের থাকতে হবে। সাবেক মন্ত্রীদের পরামর্শ, অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমান মন্ত্রীরা অনেকদূর এগুতে পারে। সামনে ঈদ উল আজহা। এই সময়ে বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তো সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর পরামর্শ নিতেই পারেন। শিল্পের সমস্যা নিয়ে বর্তমান শিল্পমন্ত্রীর সাবেক শিল্পমন্ত্রীর বাধা কোথায়? এটার ফলে একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার সৃষ্টি হলো কিন্তু সেটা না করে সবকিছু বদলে ফেলার নামে দোষারোপের সংস্কৃতির রাজনীতি আওয়ামী লীগকেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলছে।
বাংলা ইনসাইডার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন