একাদশ সংসদ নির্বাচন-উত্তর নতুন সরকার গঠনের ১৩২ দিনের মাথায় মন্ত্রিসভা পুনর্বিন্যাস করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাঁচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর পুনর্বণ্টন করেছেন টানা তৃতীয়বারের এ প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে দুই মন্ত্রীর কর্মক্ষেত্র কমবে। অন্যদিকে দুই প্রতিমন্ত্রীর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গতকাল রবিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম স্বাক্ষরিত পৃথক দুই আদেশপত্রে পাঁচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর পুনর্বণ্টন করা হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের
মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামকে এখন শুধু স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে একক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে শুধু ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এখন থেকে এককভাবে দায়িত্ব পালন করবেন জুনাইদ আহমেদ পলক। এ বিভাগে আর পূর্ণমন্ত্রী থাকলেন না। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে করা হয়েছে তথ্য প্রতিমন্ত্রী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬-এর রুল ৩ (৪) অনুযায়ী মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে মন্ত্রণালয়/বিভাগের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট আদেশে বলা হয়েছে।
মন্ত্রিসভায় রদবদল, দপ্তর পুনর্বণ্টন কিংবা আকার বাড়ানো সরকারের নিয়মিত কাজেরই অংশ হলেও সরকার গঠনের পর স্বল্প সময়ের মধ্যে পাঁচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর পুনর্বণ্টনের বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম দ্রুত সম্পাদন এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্যই প্রধানমন্ত্রী এ উদ্যোগ নিয়েছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচিত ডা. মুরাদ হাসান এবারই প্রথম মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। কুমিল্লা-৯ আসন থেকে নির্বাচিত মো. তাজুল ইসলামও প্রথমবারের মন্ত্রী। পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়কে ভাগ করে তাকে শুধু স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের একক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করে আসা প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যকে। যশোর-৫ আসন থেকে নির্বাচিত এই সাংসদও এবারই প্রথম মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। টেকনোক্র্যাট কোটায় এবার দ্বিতীয়বারের মতো ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মোস্তাফা জব্বার। সর্বশেষ পুনর্বণ্টনে তার দায়িত্বের ক্ষেত্র কমবে। তাকে শুধু ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে এককভাবে দায়িত্ব পালন করবেন প্রতিমন্ত্রী নাটোর-৩ আসনের এমপি জুনাইদ আহমেদ পলক।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মোর্ত্তজাকে নিয়ে গত মাসে ফেসবুকে অশ্লীল ভাষায় মন্তব্য করায় চিকিৎসকদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। নিজের নির্বাচনী এলাকার একটি হাসপাতালে এক চিকিৎসককে কর্মক্ষেত্রে না পেয়ে তাকে ফোন করে ধমক দিয়েছিলেন মাশরাফি। এর প্রতিবাদে চিকিৎসকরা মাশরাফির সমালোচনা শুরু করলে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চিকিৎসকদের সমালোচনা করেন। সে সময় ডা. মুরাদ বলেন, মাশরাফি জাতীয় সংসদের সদস্য। শ্রদ্ধা-সম্মান কোনোদিন কেউ চেয়ে নিতে পারে না। এটা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা দেন। ভুলেও ভাববেন না যে একজন সম্মানের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত থাকা মানুষকে অসম্মানিত করে আপনি সম্মানিত হবেন। কোনোদিনও হবেন না। কখনো হতে পারবেন না। এটা দয়া করে মনে রাখবেন চিকিৎসক ভাইয়েরা। সে সময় তিনি চিকিৎসকদের উদ্দেশে আরও প্রশ্ন রাখেন, একজন মাশরাফি সৃষ্টি করতে পারবেন আপনারা? হতে পারবেন নাকি জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন? হতে পারবেন একজন জাতীয় ডাক্তার? হয়ে প্রমাণ করুন যে, আপনি মাশরাফিকে নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা রাখেন।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যকে আক্রমণাত্মক দৃষ্টিতে দেখেছে চিকিৎসকসমাজ। চিকিৎসকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নেতারা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হন। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করায় কেউ কেউ ধারণা করছেন, এর নেপথ্যে বিএমএ নেতাদের ক্ষোভ প্রভাব ফেলেছে।
এদিকে অন্য একটি সূত্র বলেছে, নানা বিষয়ে ডা. মুরাদের সঙ্গে তার মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী জাহেদ মালেক স্বপনেরও বনিবনা হচ্ছিল না বলে আলোচনায় ছিল। এটিও মুরাদকে এ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার আরেক কারণ হতে পারে।
সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যেও নানা বিষয়ে মতভিন্নতা দেখা দেয়। কাজে গতি আনতে মন্ত্রণালয়টি দুই ভাগে ভাগ করে দুজনকে দুই বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেকে মনে করেন, একই কারণ কাজ করেছে মোস্তাফা জব্বার ও জুনাইদ আহমেদ পলকের ক্ষেত্রেও।
সরকার গঠনের মাত্র সাড়ে চার মাসের মাথায় কেন হঠাৎ দপ্তর পুনর্বণ্টনÑ এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম আমাদের সময়কে বলেন, কাজের সুবিধার্থে মন্ত্রণালয়কে ভাগ করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এতে করে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যে কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নিতে পারবেন। প্রতিমন্ত্রী ফাইলে সই করলে মন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আবার মন্ত্রীকেও প্রতিমন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এতে করে কাজের গতি আসবে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর গত ৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। দশম সংসদের মন্ত্রিসভার হেভিওয়েট মন্ত্রীদের বেশিরভাগই নতুন মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই পাননি। ২৪ মন্ত্রী, ১৯ প্রতিমন্ত্রী ও ৩ উপমন্ত্রীর সমন্বয়ে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা সাজান প্রধানমন্ত্রী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন