একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে সাংগঠনিক তেমন কোনো কর্মকাণ্ডে নেই ঢাকা মহানগর বিএনপি। এমনকি শীর্ষ নেতাদের কারও দেখা পাচ্ছেন না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। মহানগরের (উত্তর ও দক্ষিণ) কেন্দ্রীয় কার্যালয় অধিকাংশ সময়ই থাকছে তালাবদ্ধ।
এ নিয়ে তৃণমূলে হতাশা বিরাজ করছে। পদত্যাগ করেছেন ঢাকা মহানগরের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ও থানার দুই প্রভাবশালী নেতা। এ পরিস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক জেলা শাখা নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে আগামী মে মাসের শুরুতে ঢাকা মহানগর নেতাদের নিয়ে বসবেন বিএনপি হাইকমান্ড।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও এর বর্ষপূর্তি ঘিরে বিএনপি ঘোষিত লাগাতার আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য অনেকটা দায়ী করা হয় ঢাকা মহানগরকে। তাই সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করতে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ঢাকা মহানগরকে উত্তর ও দক্ষিণ- দুই ভাগ করে নতুন কমিটি দেয়া হয়। অথচ বর্তমান কমিটিরও দৃশ্যমান কোনো সফল্য নেই।
৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় মহানগরের নেতারা। নেই নিজস্ব কোনো কর্মসূচি। এমনকি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে একটি মিছিলও করতে পারেনি। কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতেও কয়েকজন নেতা ছাড়া তেমন কাউকে দেখা যায় না। মহানগরের এমন পরিস্থিতির কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ ও হতাশা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, দক্ষিণের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে। তার বিরুদ্ধে আড়াইশ’রও বেশি মামলা। আমার বিরুদ্ধেও অসংখ্য মামলা। বিএনপির কেন্দ্র থেকে দৃশ্যমান বড় কোনো কর্মসূচিও দিচ্ছে না। শুধু জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দুটি কর্মসূচি ছিল, যেখানে মহানগরের নেতাকর্মীরা ছিলেন। তবে তাদের উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না। কারণ সব নেতাকর্মী মামলায় জর্জরিত। তিনি বলেন, তবে বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। নেতাকর্মীদের সঠিকভাবে মূল্যায়নও করতে পারিনি। সঠিকভাবে পরিচর্যা করা যায়নি। বিভিন্ন কারণে তারাও হতাশ।
ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আহসানউল্লাহ হাসান যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে মহানগরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি গায়েবি মামলা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি মামলায় ১৬০ থেকে ১৭০ জন আসামি। আমার নামেও মোট ৮০টি মামলা। নেতাকর্মীদের জামিন নিয়েই আসলে আমরা এখন ব্যস্ত। প্রতিদিন আদালতের বারান্দায় থাকতে হচ্ছে। এসব কারণে কর্মসূচিতে নেতাকর্মীর সংখ্যা একটু কম।
মহানগরের মধ্যম পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, তাদের প্রত্যাশা ছিল চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে অন্তত আলাদা কর্মসূচি দেবে ঢাকা মহানগরের শীর্ষ নেতারা। ৩০ ডিসেম্বরের পর কেন্দ্রীয় বিএনপি যেসব কর্মসূচি দিয়েছে তাতে উত্তর ও দক্ষিণের দুই সাধারণ সম্পাদকসহ মহানগরের কয়েকজন নেতা ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম।
যা নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকরাও তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দক্ষিণের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল বাইরে থাকলে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচির ব্যাপারে কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতেন না। তিনিই কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে থাকতেন। কারাগারে যাওয়ার আগে দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে কয়েকশ’ নেতাকর্মী নিয়ে সোহেল উপস্থিত থাকতেন।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে নয়াপল্টনে মহানগর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভাসানী ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের মূল গেট বন্ধ। কিছুক্ষণ পর পিয়ন মোহাম্মদ সুজন এসে জানান, নির্বাচনের আগে সব সময় নেতাকর্মীদের ভিড় থাকত কার্যালয়ে। নির্বাচনের পর থেকে কোনো নেতাকর্মী কার্যালয়ে আর আসেন না। এজন্য দোতলায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। উত্তরের দফতর সম্পাদক এখনও কারাগারে। দক্ষিণের দফতর সম্পাদকের বিরুদ্ধেও অনেক মামলা রয়েছে। যে কারণে হয়তো তিনিও আসেন না।
ঢাকা মহানগর উত্তরের সহসভাপতি ফেরদৌসি আহমেদ মিষ্টি যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের পর থেকে মহানগর উত্তরের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। কর্মসূচি হলে আগে মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হতো। এখন কোনো কিছুই জানানো হয় না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কয়েকদিন কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও আমরা তা টেলিভিশন দেখে অথবা পত্রিকা পরে জানতে পারি। তিনি বলেন, ঢাকা মহানগর উত্তরের অবস্থা খুবই খারাপ।
সভাপতি তো বিদেশে থাকেন। সাধারণ সম্পাদকের দেখা পান না নেতাকর্মীরা। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রশ্ন- যেখানে ম্যাডাম খালেদা জিয়া নিজেই অসুস্থতার কথা জানিয়েছেন, তারপরও কেন তার মুক্তির দাবিতে ঢাকা মহানগরের কর্মসূচি নেই।
সম্প্রতি এ নিয়ে ঢাকা মহানগরের নেতা জাকির হোসেন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘নেতাশূন্য ঢাকা মহানগর বিএনপি, অফিস যেন ভুতুড়ে অবস্থা।’ অপর এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘আন্দোলনের চালিকাশক্তি ঢাকা মহানগর বিএনপির চালক নেই! মূল কমিটির বেশির ভাগের সরকার দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ!’
ঢাকা মহানগর উত্তরের একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, উত্তরের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির শীর্ষ পদ নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। কমিটির অনেক নেতা তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, সভাপতি আবদুল কাইয়ুম মালয়েশিয়া বসবাস করছেন। তিনি কিভাবে বিদেশে থেকে মহানগর উত্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ শাখা দেখভাল করবেন। সে সময় সাধারণ সম্পাদক আহসানউল্লাহ হাসানকে অনেকে মেনে নিতে চাননি। পরে বিএনপির হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপে দুই শীর্ষ নেতাকে মেনে নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন কমিটিতে থাকা অন্য নেতারা।
কিন্তু গত বছরের ৪ মে উত্তরের থানা ও ওয়ার্ড কমিটি ঘোষণার পর তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে মালয়েশিয়া অবস্থানরত উত্তরের সভাপতির স্ত্রী শামীম আরা বেগমকে ঢাকা-১১ আসনে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। আর ঢাকা-১৬ আসন থেকে মনোনয়ন পান সাধারণ সম্পাদক হাসান। যে কারণে উত্তরের একটি বড় অংশ নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে নীরব ছিলেন।
এদিকে শারীরিক ও পারিবারিক কারণ দেখিয়ে শনিবার বিএনপির সব পর্যায়ের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তরের সহ-সভাপতি ছিলেন। একই সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া ‘মূল্যায়ন’ না পেয়ে বিএনপির সব পদ থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন কোতোয়ালি থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা সাইফুল।
সম্প্রতি তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির কার্যালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। মোল্লা সাইফুল যুগান্তরকে বলেন, থানা কমিটি ঘোষণার আগে আমি সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু আমাকে মূল্যায়ন না করে সাংগঠনিক সম্পাদক (২ নম্বর) করা হয়। তিনি বলেন, দলে আমাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। এরপরও থানা কমিটির রাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ড তাকে একাই সামলাতে হয়েছে। আমার পক্ষে এখন আর এত বোঝা বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বিএনপির সব পদ থেকে পদত্যাগ করার পাশাপাশি রাজনীতি ছাড়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার বলেন, অনেকেই বলছেন মোল্লা সাইফুলের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে তাই সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। যাহোক আমাদের প্রতি থানায় তিনজন করে সাংগঠনিক সম্পাদক রয়েছেন। একজন চলে গেলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন