জামায়াতে ইসলামীকে জোটের বাইরে রাখতে নানা প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। নানা মতের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, তা হলো ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া।
অর্থাৎ ২০ দল ভেঙে দেওয়া হলে জামায়াত ছেড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটি আর আসবে না। এ ইস্যুতে বুধবার দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে বেশ আলোচনা চলতে থাকে।
দেশি-বিদেশি নানা মহলের চাপে বিএনপি নেতা এবং দল সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই জামায়াত ছাড়তে পরামর্শ দেন। এমন আলোচনার মধ্যে মাসখানেক আগে জামায়াতই ২০ দলের বৈঠক ও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করে বিএনপির সঙ্গ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। দলের কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, দলে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এখন জামায়াতের প্রসঙ্গটি ঘুরেফিরে আসছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাংগঠনিক জেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠকেও জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত কিনা সেই মতামত নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে দল-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গেও তার কথা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে বুধবারের বৈঠকে উপস্থিত থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির চার নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কেউ এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বুধবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমান। তিনি বরাবরই জামায়াতের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
আমাদের সময়কে তিনি বলেন, জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে দলে আলোচনা চলছে। তবে সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, আমি বরাবরই জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে। কারণ জামায়াত বিএনপির জন্য বড় দায় হয়ে পড়েছে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আলোচনা থেকে জানা যায়, জামায়াত ছাড়তে হলে কীভাবে তা করা যায় এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কেউ কেউ বলছেন, জামায়াতকে ২০ দলের বাইরে থাকার পরামর্শ দেওয়া উচিত।
কারও মতে, পুরো জোটই ভেঙে দিতে হবে। ২০ দলের কোনো প্রয়োজনীয়তা এখন আর নেই। ঐক্যফ্রন্ট থেকেও সরে আসার মত দেন কয়েকজন। এক নেতা বলেন, জামায়াতকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলে দলটির সঙ্গে বিএনপির তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হবে। পুরো জোট ভেঙে দেওয়া হলে সম্পর্ক খারাপ হবে না। আবার ভালো সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু তিক্ততা তৈরি হবে না।
দলের একাধিক নীতিনির্ধারকের মতে, জামায়াত চলে যেতে চাইলে তাদের বাধা দেবে না বিএনপি। বরং তারা খুশিই হবে। কারণ যুদ্ধাপরাধের এই দলের দায় ঘুরে-ফিরে বিএনপির ওপর আসছে। দেশ ও বিদেশের কেউ-ই বিষয়টি ভালোভাবে দেখছে না। এই মতের সঙ্গে একমত পোষণ করে কয়েকজন নেতা মনে করেন, জামায়াতকে ছেড়ে দিলে রাজনৈতিক ফায়দা কী, লাভ-ক্ষতিটা মূল্যায়ন করতে হবে।
সরকার তাদের নিয়ে রাজনীতি করছে। সরকার চাইলে যে কোনো সময় জামায়াত নিষিদ্ধ করা সম্ভব। তারা তা করছে না কেন? তারা রাজনীতি করলে বিএনপিরও রাজনীতি করা উচিত। অবশ্য বিএনপির তৃণমূলের মতামত জামায়াতের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে বেশি। তৃণমূল নেতারা বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াত থাকলে বিএনপির বিশেষ কোনো সুবিধা নেই। বিএনপি ‘একাই একশ’।
২ মার্চ ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির বৈঠকের মাধ্যমে সাংগঠনিক জেলার সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেন তারেক রহমান। বৈঠক শেষে জেলা সভাপতি মো. তৈমুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি জামায়াতকে জোটে রাখার সুবিধা ও অসুবিধা- দুটিই বলেছি। ’৯৬ সালে জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তাদের সঙ্গে ভোটের জোটে রাখলে কী হতে পারে তার মত দিয়েছি। এও বলেছি, জামায়াতকে ছেড়ে দিলে কোনো সমস্যা নেই। বিএনপি একাই একশ। নির্বাচন ও আন্দোলন আমরা একাই করতে পারি।’
সম্প্রতি জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক জামায়াত নেতৃত্বের সমালোচনা করে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি মনে করেন, জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং দল বিলুপ্ত করা উচিত। আবদুর রাজ্জাক যখন এ বক্তব্য দেন, তখন লন্ডনে ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। ধারণা করা হচ্ছেÑ দুই জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে তারেক রহমান এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ওই সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
তার এ বক্তব্যের পর দলের নেতারা ধারণা করেছেন, জামায়াতের ব্যাপারে এটি বিএনপির নতুন মনোভাব। বুধবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্কাইপে তারেক রহমানের উপস্থিতিতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতাদের কয়েকজন বলেন, রাজনীতি এখন অনেকটাই জোটকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এর থেকে বের হতে হবে। ওই নেতা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল নাকি ভুল ছিল তা ইতিহাস একদিন তুলে ধরবে। নির্বাচনে যা অর্জন হওয়ার তা হয়েছে।
তাই এবার ঐক্যফ্রন্ট রাজনীতিকে বন্ধ করে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বৈঠকে জামায়াতের প্রসঙ্গটি এজেন্ডায় না থাকলেও আলোচনার একপর্যায় এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতপন্থি বলে পরিচিত এক নেতা বলেন, জামায়াত ছাড়তে হবে। এদের কারণে বিদেশিদের সঙ্গে আমরা কথা বলতে পারি না। কমিটির একজন সিনিয়র সদস্য বলেন, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের বিরোধিতা করেছিল শিবির।
বিএনপি জোটে জামায়াত থাকায় নতুন প্রজন্ম ডাকসুতে আমাদের ভোট দেয়নি। এর জবাবে অপর এক নেতা বলেন, জামায়াত থাকার কারণে ভোট কমলে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে জোট হওয়ায় আমাদের ভোট কমেছে। কারণ জয়বাংলা সেøাগানধারীদের সঙ্গে জোট হয়েছে। এতে বিএনপি সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হয়েছে। এর মধ্যে একজন জোটের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সংসদে যোগ দিয়ে এখন বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
বৈঠকে জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে ভিন্নমতও আসে। কয়েকজন নেতার মতে, আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারত জামায়াতের বিরোধিতা করছে। কিন্তু সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না। রাজনীতির প্যাঁচে যাতে আমরা না পড়ি, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকার রাজনীতি করতে চাইলে আমাদের সাবধানে পা দিতে হবে। আমরা সরকারের এজেন্ডা যাতে বাস্তবায়ন না করি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন