এই প্রথম নয়, আগেও চাপে পড়ে পর্দার আঁড়ালে চলে যায়। সুযোগ বুঝে আবার সামনে আসে। দলটির নাম জামায়াতে ইসলামী। যাদের নামের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে আছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে বিরোধী অবস্থান নিয়ে সক্রিয় থাকার।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার বিষয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠলেও জামায়াতের নেতারা কখনো সেটিকে পাত্তা দেননি।
সম্প্রতি দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা ঠিক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ইস্যুতেই জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন। ওই কলঙ্ক মোচনে তিনি দলটি বাংলাদেশে বিলুপ্ত করারও পরামর্শ দিয়েছেন পদত্যাগপত্রে।
বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানকারী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের এই পদত্যাগে নড়েচড়ে বসেছে দলটি। দলের সংস্কারপন্থীদের কোণঠাসা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মজিবুর রহমান মঞ্জু নামে এক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
অবশ্য নিজে থেকেই ভুল বুঝতে পেরে স্থানীয় পর্যায়ের আরেক নেতাও পদত্যাগ করেছেন।
জানা গেছে, একাধিক নেতা যেমন পদত্যাগের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন, তেমনি অনেক নেতাকেই সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে জামায়াত।
দলের ভেতরে এমন অস্থিরতায় প্রশ্ন সামনে এসেছে, পদত্যাগ আর ছাঁটাইয়ে জেরবার জামায়াত কী তবে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর বিলীন হতে চলেছে?
আপাতত এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর নেই। তবে, রাজনৈতিক বোদ্ধারা একবারে সম্ভাবনা নাকচ করছেন না। তারা নতুন নামে দলটির ভিন্নভাবে রাজনৈতিক উত্থানের কথা বলছেন। সেটি বাস্তবায়নেই পদত্যাগ-বহিষ্কার নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে বলেও মত দিয়েছেন।
অবশ্য ইতোমধ্যে জামায়াত আদালতের নির্দেশের পর তাদের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারিয়েছে। সরাসরি দলীয় প্রতীক নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি দলটির নেতারা। বিএনপির জোটে থাকায় দলটির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে দুই ডজন নেতা নির্বাচনে লড়লেও কেউ জিততে পারেননি।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি এই পদত্যাগকে স্বাগত জানান এবং আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে তাদের ‘মহব্বতের’ সম্পর্ক থাকবে বলে উল্লেখ করেন।
এরপরই ১৬ ফেব্রুয়ারি সংস্কারপন্থী নেতাদের ওপর চড়াও হয় জামায়াত। দলটির মজলিশে শুরার সদস্য ও ছাত্রশিবিবের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুকে বহিষ্কার করা হয়।
ওইদিনই দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার জামায়াত নেতা বখতিয়ার উদ্দীন পদত্যাগ করেন। তিনি ছাত্রশিবির নীলফামারী শাখা জেলার সাবেক সভাপতি ও ভেড়ভেড়ী ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।
এরপরই চাউর হয়, জামায়াতের আমির পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন মকবুল আহমাদ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদনও হয়। যদিও পরে জামায়াত বিবৃতি দিয়ে মকবুল আহমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক মো. তাসনীম আলম বলেন, ‘মকবুল আহমাদের জামায়াতের আমির পদে না থাকা বা পদত্যাগ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করার প্রশ্নই আসে না। দলের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার হীন-উদ্দেশ্যেই এমন অসত্য তথ্য বাজারে ছাড়া হয়েছে।’
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দীর্ঘদিন জামায়াতের নেতৃত্বে থাকা শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতারই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ফলে দলে চরম নেতৃত্ব সঙ্কট বিরাজ করছে। এর উপর দ্বিতীয় সারির নেতারাও বিগত ১০ বছরে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এখন পদত্যাগ এবং ছাঁচাইয়ের ফলে দলটিতে বিরাট নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি হবে।
এর সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে জামায়াতের ‘রাজনীতি’ নিষিদ্ধের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে জোটের কারণে এতদিন সেটি সম্ভব না হলেও এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বিএনপিই ঘরকোণে বন্দি। তারাও চাইছে জামায়াতের রাহুমুক্ত হতে।
যেমনটি বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদের ভাষ্যে, ‘একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতের অনেক আগেই ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।’
বিএনপি জোটে জামায়াতের বর্তমান অবস্থানও স্পষ্ট করেন তিনি, ‘জামায়াত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিএনপির সঙ্গে জোট করেছিল। কিন্তু, এখন সে বাস্তবতার অবসান হয়েছে। বিএনপির জামায়াতকে আর কোনো প্রয়োজন নেই।’
তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভাঙনের মধ্যেই এখন হয়তো ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে নতুন একটি সেক্যুলারভিত্তিক রাজনৈতিক দল হবে। সেখানে জামায়াত-শিবিরের তরুণ প্রজন্ম আসবে। স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করে তারা এগিয়ে যাবে। সরকারি দলের নেতাদের পক্ষ থেকে এটি জামায়াতের ‘কৌশল’ বলা হচ্ছে। নতুন মোড়কে পুরনো মালই ফিরে আসার আশঙ্কাও তারা উড়িয়ে দেননি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ছিল জামায়াতের রাজনৈতিক ভুল। পরে এজন্য জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়া সেই ভুলকেই আরও বড় করেছে। এখন সময় এসেছে, বিএনপির উচিত হবে, দলটিকে জোট থেকে বের করে দেয়া। সঙ্গে জামায়াত নামে রাজনীতি নিষিদ্ধের যে দাবি, তাতে শামিল হওয়া।’
জামায়াতের বর্তমান অস্থিরতার বিষয়ে দলের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিমসহ একাধিক শীর্ষনেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেন্দ্রীয় নেতা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী আদর্শিক দল। কোনো অবস্থাতেই দলটির মৃত্যু বা বিলীন হবে না। দু’একজন নেতা চলে গেলেও কোনো প্রভাব পড়বে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াত কোনো একক নেতা কিংবা সমর্থক নির্ভর দল নয়। কর্মী নির্ভর দল। নেতাদের সার্বক্ষণিক গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ রয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই নেতার পর নেতার ক্রম তৈরি হয়ে আছে। সাময়িক সঙ্কট এলেও, সেটি সামলাতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন