মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী জাতির কাছে ঘৃণিত সংগঠন হওয়ায় তাদের সঙ্গে বিএনপি আর থাকতে চাইছে না। ২০ বছর ধরে চলা সঙ্গীকে ২০-দলীয় জোটেও দেখতে চায় না দলটি। ইতোমধ্যে নীতিগতভাবে দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।
সূত্রমতে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেই দলটি নীতিগতভাবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগের জন্য বিএনপির হাইকমান্ডের ওপর দল ও দলের বাইরে থেকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যদিও কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়া বেশ কয়েক বছর আগেই দলের দায়িত্বশীল নেতাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, জামায়াত নিজে থেকে গেলে যাক; তবে বিএনপি ঘোষণা দিয়ে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবে না। কিন্তু প্রস্তাব অনুযায়ী একাত্তরের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া ও জামায়াতকে বিলুপ্ত না করার হতাশা থেকে পদত্যাগ করেছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক। তাছাড়া জামায়াতেরও বেশিরভাগ নেতা ২০-দলীয় জোট ছাড়ার পক্ষেÑ এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি এবং ফেব্রুয়ারিতে জামায়াতের মজলিশে শূরার বৈঠক হয়। সেখানে বিএনপিকে ছাড়া সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে জামায়াতের যাত্রা করার বিষয়েও আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে গঠনতন্ত্রে সংশোধনীও আনা হয়েছে। এ অবস্থায় ২০-দলীয় জোটে জামায়াতকে রাখার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই বলে মনে করে বিএনপির হাইকমান্ড।
জামায়াত যদি বিএনপির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করে তাদের জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে বলে দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা আমাদের সময়কে নিশ্চিত করেছেন। ওই নেতা বলেন, সম্প্রতি তারেক রহমানের সঙ্গে দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার জামায়াত প্রসঙ্গে নিয়ে কথা হয়েছে। সেখানে তারেক রহমান জামায়াতকে ২০-দলীয় জোটের বাইরে রাখতে ওই দুই নেতাকে বলেছেন। এ-ও বলেছেন, জামায়াত যদি বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করে, তা হলে যেন এটা করা হয়।
গতকাল যোগাযোগ করলে জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী ব্য্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক আমাদের সময়কে বলেন, একাত্তরের ভূমিকার কারণে জামায়াত দেশে ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিল। একটি দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কেউ সে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেÑ এ রকম কোনো ইতিহাস আমার কাছে নেই। জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে সব সময় ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, আমি সব সময় মনে করি, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট থাকা উচিত নয়। ২০-দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ আমাদের সময়কে বলেন, ২০-দলীয় জোটের সব শরিকের ঐক্য বিএনপির সঙ্গে। জামায়াত থাকা না থাকায় জোটে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না।
সম্প্রতি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের আমাদের সময়কে বলেন, ২০-দলীয় জোট মূলত নির্বাচনী জোট। নির্বাচন ঘিরে তাদের জোটভুক্ত কার্যক্রম হয়। যেহেতু এখন কোনো নির্বাচনে কেউ যাচ্ছে না, তাই জামায়াত নিজেদের দলের ব্যাপারে প্রাধান্য দিচ্ছে।
শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম আমাদের সময়কে বলেন, আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হলেও জামায়াত নতুন নামে দল গঠন করবে, তা আমরা শুনেছি। নতুন দল হলে ২০ দলে তারা থাকতেও পারে, না-ও পারে। বিগত জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও আন্দোলনে জামায়াতের বর্তমান নেতাদের কর্মকা- বিশ্লেষণ করে বিএনপির শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতা এবং সাধারণ নেতাকর্মীদের সন্দেহ, জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের বড় একটি অংশের সঙ্গে সরকারের গোপন সম্পর্ক আছে। সর্বশেষ উদাহরণ সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০-দলীয় জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করা।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তাদের ভূমিকা ছিল অপ্রত্যাশিত। ওই নির্বাচনে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া না যাওয়ার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। সেবারও মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ- কার্যকর হওয়া আলী আহসান মুজাহিদ খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক বৈঠকে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
কাগজ-কলম ছুড়ে ফেলে খালেদা জিয়াকে মুজাহিদ বলেছিলেন, আপনি নির্বাচনে না গেলেও জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেবে। জামায়াত ও প্রতিক্রিয়াশীল কিছু বুদ্ধিজীবীর চাপে ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে খালেদা জিয়ার পরাজয়ের আশঙ্কা সঠিক হয়। দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের মতামতে জামায়াতকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। ওই সময়ই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া নেতারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে জামায়াতের আমির মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী বানানো হয়। এ নিয়ে বিএনপিকে ঘরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এখনো সেই সমালোচনা বহন করতে হচ্ছে বিএনপিকে।
২০০১ সালে চারদলীয় জোট গঠনের পর জামায়াত তাদের আসল রূপ প্রকাশ করে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল, বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর হামলা-নির্যাতনসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের অত্যাচারে কোথাও কোথাও বিএনপিও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জামায়াত যে একটি সুবিধাবাদী দল, সেটা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায় ওয়ান-ইলেভেনের সময়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলে জামায়াতের কাছে বিবৃতি চাইলে দলটির সেক্রেটারি জেলারেল আলী আহসান তৎকালীন বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিবের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি করবেন আপনারা, বিবৃতি আশা করেন কীভাবে? বিএনপির স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলের স্বাধীনতাবিরোধী অপবাদ সহ্য করা বড়ই কঠিন। জামায়াত নেতারাই তাদের অতীত কৃতকর্মের জন্য সংগঠনটিকে বিলুপ্ত করার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। এখন কোনোভাবেই তাদের ধরে রাখা ঠিক হবে না। বিদায় জানানোর এটাই উপযুক্ত সময়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন