বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের পর গতকাল পদত্যাগ করেছেন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ভেড়ভেড়ী ইউনিয়ন জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মো. বখতিয়ার উদ্দিন। পদত্যাগপত্রে তিনি জামায়াতে ইসলামীকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী দল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
উপজেলা জামায়াতের আমিরের কাছে গতকাল শনিবার ডাকযোগে লিখিত পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি। যার অনুলিপি জেলা জামায়াতের আমিরের কাছেও পাঠানো হয়েছে। পদত্যাগপত্রে বখতিয়ার লিখেছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে তার অস্পষ্টতা ছিল। কিন্তু গত শুক্রবার দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও আইনজীবী আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগপত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছেন জামায়াতে ইসলামী একটি স্বাধীনতাবিরোধী দল। তাই এ দেশের নাগরিক হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে তিনি থাকতে চান না।
একই সঙ্গে জামায়াতকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন বখতিয়ার উদ্দিন। দল থেকে বহিষ্কৃত কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য মজিবুর রহমান মনজুও গতকাল ফেসবুকে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক এ সভাপতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে দলীয় নীতিরও সমালোচনা করেছেন। জামায়াতের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগে থেকেই চাপ রয়েছে।
দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোও জামায়াতের সঙ্গ এড়িয়ে যায়। ২০ বছর আগের সঙ্গী বিএনপিও জামায়াতকে আগের মতো গুরুত্ব দেয় না। দেশি-বিদেশি চাপে থাকা জামায়াতের টিকে থাকা যখন অনিশ্চিত, তখন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ, আরেক নেতার একই পথ অনুসরণ এবং মনজুর ফেসবুক পোস্ট ইত্যাদি থেকে নতুন বার্তাটি উঠে এসেছে, তা হলোÑ চেইন অব কমান্ড মেনে চলা জামায়াত এখন খুবই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে একাত্তর প্রশ্নে অনেক দিন ধরেই চলছিল মতবিরোধ।
সম্প্রতি এ ইস্যু নিয়ে দলের অভ্যন্তরে মতবিরোধ চরমে পৌঁছেছে। শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংগঠনটির একটি বড় অংশেরই প্রশ্ন ছিল, যা দিন দিন বড় হয়েছে। এখন প্রশ্ন জেগেছে, মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী? এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জামায়াতের ভবিষ্যৎ জামায়াতই ভালো বলতে পারবে।
চিন্তাভাবনা করে জামায়াতকে বিলুপ্ত করে একাত্তরের ভুলের জন্য জাতির কাছে তাদের মাফ চাইতেই হবে। এ ছাড়া পথ নেই। মাফ পেলে যে কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। পৃথক দল করলেও তাদের কালিমা থেকে যাবে। তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে থাকাটাও ভুল হয়েছে। মস্ত বড় ভুল। এটি দেশে যেমন সমস্যা সৃষ্টি করেছিল, আন্তর্জাতিক মহলেও তেমনই বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। জামায়াতের উচিত হবে, দলটি বিলুপ্ত করে একাত্তরের ভূমিকার জন্য মাফ চেয়ে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করা। যে দল তাদের গ্রহণ করবে, তাদের সঙ্গে কাজ করা।
পৃথক দল করলে হবে না, যে কোনো দলের সঙ্গে মিলতেই হবে। জামায়াত দল হিসেবে বিলুপ্ত না হলে এবং একাত্তরের ভূমিকার জন্য মাফ না চাইলে টিকে থাকবে পারবে কিনা? এমন প্রশ্নে প্রবীন এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, সম্ভব নয়। টিকবে কী করে? একা একা তো টেকা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মুক্তিযুদ্ধে দলের ভূমিকা ইস্যুতে জামায়াত এখন একঘরে হয়ে পড়েছে বলা চলে। একাত্তর এবং এর পরবর্তী সময়ে জামায়াতের যে অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল, এখন তাও নেই। জামায়াতকে অর্থ দিয়ে যারা বিভিন্নভাবে সাহায্য করত সেসব অর্থদাতাদের অনেকেই এখন জামায়াতের সঙ্গে নেই। আগে দলটির যে সাংগঠনিক শক্তি ছিল, তাও এখন আর নেই। মাঠপর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীই নিষ্ক্রিয়।
বলা চলা সার্বিক অর্থেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জামায়াত। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় জামায়াতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আমি বরাবরই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি করে আসছি। জামায়াতকে বিলুপ্ত করে নতুন নামে দল গঠন করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের সব নাগরিকেরই রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে যে কেউ রাজনীতি করতে পারে। তবে ধর্মভিত্তিক কোনো দল রাজনীতি করুক তার পক্ষে আমি নই।
এ ক্ষেত্রে তারা নতুন দল গড়লেও তাদের গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি করতে হবে। খোদ জামায়াতেরই এক নেতা বলেছেন, আমাদের দল যে সংকটে পড়েছে এ থেকে উত্তরণে এ মুহূর্তে যতটা দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব দরকার ছিল, তা আমাদের নেই। আজকের এ সংকটের জন্য দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের একগুঁয়েমি এবং বিভিন্ন পর্যায়ে যোগ্য-দক্ষ নেতা নির্বাচনে ব্যর্থতাও দায়ী। তিনি যোগ করেন, জামায়াতের উত্তরাঞ্চলের নেতাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। জামায়াতের রাজশাহী অঞ্চলের এক নেতা অভিযোগ করেন যে, ২০১৭ সালের প্রথম দিকে এক যুগেরও অধিক সময় রাজশাহী মহানগর আমিরের দায়িত্ব পালন করা আতাউর রহমানকে (প্রয়াত) বহিষ্কার করা হয়েছিল।
এ ঘটনায় জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য ও উত্তরাঞ্চলের নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তৎকালীন নায়েবে আমির আতাউর রহমান সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের দেওয়া চাঁদায় গড়ে ওঠা ফান্ডের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনেন। এর জেরে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে একটি মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে এর দায়ে সে সময় আতাউর রহমানকে বহিষ্কার করা হয়।
বর্তমান কমিটির আমলেই জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য মজিবুর রহমান মনজুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মজিবুর রহমান নিজেই গতকাল শনিবার তার ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে বহিষ্কারের বিষয়টি জানিয়েছেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সূত্রও বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বহিষ্কারের বিষয়ে মজিবুর রহমান তার ফেসবুক পোস্টে জানান, ‘গতকাল শুক্রবার আনুমানিক রাত সাড়ে ৭টার দিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত আমির জনাব মকবুল আহমাদের পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য আমাকে জানান যে, আমার দলীয় সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে।’ মজিবুর রহমান জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি।
আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের ঘোষণার পর আবার মজিবুর রহমান তাকে বহিষ্কারের বিষয়টি জানালেন। পদত্যাগ করার সময় রাজ্জাক যেমন দলের সঙ্গে তার মতভিন্নতার কথা উল্লেখ করেছিলেন, মজিবুরও তার দীর্ঘ পোস্টে দলের কিছু নীতির বিষয়ে তার মতভিন্নতার কথা জানিয়েছেন। মজিবুর লিখেছেন, ‘বেশ কয়েক বছর যাবৎ সংগঠনের কিছু বিষয়ে আমি দ্বিমত করে আসছিলাম। মৌখিক ও লিখিতভাবে বৈঠকসমূহে আমি প্রায়ই আমার দ্বিমত ও পরামর্শের কথা সম্মানিত দায়িত্বশীলদের জানিয়েছি। অভ্যন্তরীণ ফোরামের পাশাপাশি আকারে-ইঙ্গিতে প্রকাশ্যেও আমি আমার ভিন্নমত প্রকাশ করে এসেছি।’ আবদুর রাজ্জাকের এমন বক্তব্যের পর নানা মহলে গুঞ্জন উঠেছে মুখে আবদুর রাজ্জাক যাই বলুক তার দল গড়ার খায়েস মনে ভেতরে লুকানো আছে। সে ক্ষেত্রে ভালো মানুষী সেজে জামায়াতের তরুণদের নিয়ে নতুন করে পথ চলা শুরু করতেও পারেন অদূর ভবিষ্যতে।
রাজ্জাকের পদত্যাগ ও এর কারণ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আমি এটাকে খুব পজিটিভলি দেখছি। আমি মনে করি রাজ্জাক সাহেব দেরিতে হলেও তার এ উপলব্ধিটি এবং ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানোর বিষয়টি খুব ভালো দিক। আমি বিশ্বাস করব, জামায়াতে ইসলামীর সবাই তা-ই করবে; দল হিসেবেও তারা তা-ই করবে (ক্ষমা চাইবে)। বিএনপির কেন্দ্রীয় এ নেতা মনে করেন, জামায়াতকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বের করে দিলে বিএনপি বরং উপকৃতই হবে। আর এতে জামায়াতেরও লাভ বই ক্ষতি হবে না।
মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজ্জাক সাহেবের একার কথায় তো হবে না। পুরো দলকেই এটি করতে হবে। দল হিসেবেও জমায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত। বাংলাদেশের মানুষ অনেক উদার, বড় মনের। ক্ষমা চাইলে দেশবাসী হয়তো তাদের ক্ষমা করবেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন গণমাধ্যমকে বলেন, আমি তো মনে করি, জামায়াতের নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের মধ্যে এ উপলব্ধি অনেক দিন ধরেই রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের নেতৃত্বে যারা ছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধে যারা ছিল, তারাই এটি হতে দেয়নি। এখনো হতে দিচ্ছে না।
রাজ্জাকের পদত্যাগ জামায়াতের মধ্যে নতুন মেরুকরণের পথ তৈরি করবে, নতুন ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে এবং সেটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ভালো হবে বলে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটভুক্ত এ দলনেতা। তিনি বলেন, আমার মনে হয় না, আবদুর রাজ্জাকের সাম্প্রতিক সময়ের ভাষ্য দলটির কোনো কৌশল। তিনি আগে থেকেই নিজে এমন দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতেন; এখন প্রকাশ্যে বললেন। তবে এটিকে দলের অবস্থান বলা যাচ্ছে না। তবে গণমাধ্যমে যা দেখছি, তা আবদুর রাজ্জাকের পজিটিভ মুভ নিশ্চয়ই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন