উন্নয়নমুখী গণতন্ত্রকে সামনে রেখে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে এশিয়ার উন্নত দেশ চীন, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের মিসরকে মডেল হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সংসদ ও বাইরে খানিকটা নিয়ন্ত্রিত ও দুর্বল বিরোধী দলই চান তিনি।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, গণতন্ত্র নয়, দেশের উন্নয়নকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি নিয়ে খুব একটা ভাবছেন না তিনি। যেকোনো মূল্যেই দেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি বদ্ধপরিকর। দেশের উন্নয়ন করতে গিয়ে কোনো আলোচনা বা সমালোচনা আমলে না নিয়ে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাবেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা আলাপকালে বলেন, গত ১০ বছরে সংসদের ভেতর ও বাইরে বিরোধী দল ছিল অত্যন্ত দুর্বল। বিশেষ করে গত পাঁচ বছর সংসদের ভেতরে থাকা বিরোধীদল জাতীয় পার্টি সরকারের বিরোধিতা না করে বরং সহযোগী ও অংশীদার হিসেবেই ভূমিকা পালন করেছে। অন্য দিকে সরকারের দমন-পীড়নের মুখে সংসদের বাইরে থাকা সরকারবিরোধী বিএনপি জোটও সরকারবিরোধী তেমন অন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে বাধাহীনভাবে একতরফা সরকার পরিচালনা করেছে আওয়ামী লীগ জোট। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ থাকায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত রাখতে চায় সরকার। এ ক্ষেত্রে চীন, সিঙ্গাপুর ও মিসরসহ কয়েকটি দেশকে মডেল হিসেবে সামনে রেখে এগোচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সিঙ্গাপুরে ১৯৫৯ সালে লি কুয়াং ইউর নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে পিপলসথ অ্যাকশন পার্টি। ১৯৮৪ পর্যন্ত একটানা দেশ শাসন করে পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় কোনো প্রতিনিধি ছাড়াই। তারপর থেকে এক-দুইজন করে বিরোধী দলের এমপি প্রতিনিধিত্ব করেন। বর্তমানে ৮৯ আসনের পার্লামেন্টে বিরোধী দলের প্রতিনিধি মাত্র ছয়জন এমপি। পার্লামেন্টের ভেতরে ও বাইরে একটি দুর্বল বিরোধীদল নিয়ে লি কুয়াং ইউ তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন সিঙ্গাপুরের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে বিশ্বের প্রথমসারির রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীনে রাজনীতি নেই বললেই চলে। সেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় শাসন বিদ্যমান। দেশটির জনগণও রাজনীতি নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তবুও এগিয়ে যাচ্ছে চীন।
আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রসঙ্গ এলেই চলে আসে মাহাথির মোহাম্মদের নাম। তার শাসনামলের গুণগান। তিনি ১৯৮১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত একটানা ২৪ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার শাসনামলে মালয়েশিয়া শিক্ষা, বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রে একটি আধুনিক এবং অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। এ সময় প্রধান বিরোধী দলের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগারেই কাটাতে হয়।
এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশ মিসরে জনমতকে কোনো রকম তোয়াক্কা না দীর্ঘ সময় শাসন করেন সেনাশাসক হোসনি মোবারক। এ সময় মিসরের উন্নয়ন থেমে থাকেনি। সম্প্রতি আরব বসন্তের সময় তার পতন এবং মিসরের ইতিহাসে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন ড. মোহাম্মদ মুরসি। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই ক্ষমতা দখল করে পুরনো ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন করেন সেনাশাসক সিসি। কয়েক বছর ধরে মুরসি কারাগারে বন্দী রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি মূলত দুর্বল হতে থাকে ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর থেকেই। ক্রমেই সংসদের ভেতরের মতো বাইরেও অকার্যকর বিরোধী দলে পরিণত হয় বিএনপি। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে নামেই বিরোধীদল হলেও সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করে দলটি। অন্য দিকে সরকারের হামলা, মামলা, নির্যাতন আর জেল-জুলুমের মুখে কোনোভাবেই মাঠে দাঁড়াতে পারেনি সরকারবিরোধী বিএনপি। ফলে সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধীদলকে দুর্বল অবস্থায় রেখেই এগিয়ে যায় সরকার। দেশের উন্নয়নে আগামীতেও এ ধারা বজায় রাখতে চায় সরকার। বড় ধরনের কোনো বিরোধীদল থাকলে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে সরকারে। সেজন্য বিভিন্নভাবে চাপের মুখে রেখেই বিরোধী বিএনপি জোটের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও ৩০ ডিসেম্বরের অনেকটাই একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে এবার নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ জোট।
সরকারি দলের নেতারা বলেছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরের মাথায় জিডিপি হার দাঁড়ায় ৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে ৭.৮৬ শতাংশ হয়েছে। শুধু তাই নয়, অর্থনীতির চাকা এভাবে চলতে থাকলে আজকের অর্থনীতির ৩০০ বিলিয়ন ডলার ২০৩০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে ঈর্ষণীয়ভাবে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পগুলো এগিয়ে চলেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি নজর কেড়েছে বিশ্ববাসীর। তাই রাজনীতি বা গণতন্ত্র নয়, দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়াই শেখ হাসিনার লক্ষ্য। সে ক্ষেত্রে বিরোধী জোটকে চাপে রেখেই এগোবে সরকার।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েই এবার নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই ইশতেহারে উন্নয়ন-সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। এতে ২১ দফা অঙ্গীকার তুলে ধরে সেগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ইশতেহারে যে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার রয়েছে তার মধ্যে আমার গ্রাম, আমার শহরÑ প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ, তারুণ্যের শক্তি-বাংলাদেশের সমৃদ্ধি : তরুণ যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিকে রূপান্তরিত করা এবং কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, মেগা প্রজেক্টগুলোর দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য নির্মূল, সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাÑ লক্ষ্য যান্ত্রিকীকরণ, ব্লু ইকোনমি- সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নসমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি অন্যতম। ইশতেহারের মাধ্যমে মূলত একটি উন্নত দেশের স্বপ্নই দেখিয়েছেন তিনি।
তবে গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়নের কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। মানুষ উন্নয়নও চায়, গণতন্ত্রও চায়। বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ গণতন্ত্র এটি ভুলে গেলে চলবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কথা বলেন, তাদের উচিত যেকোনো মূল্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা। কারণ পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যেখানে গণতন্ত্রের রাস্তা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে, সেখানে মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়ে যায়। আর এতে উগ্রপন্থী মতবাদ হতাশাগ্রস্তদের মাঝে গুরুত্ব পায়। সুতরাং গণতান্ত্রিক ধারা অটুট না থাকলে উগ্রবাদ ভয়ানক রূপ নেবে।
তিনি আরো বলেন, দেশের উন্নয়নের কারিগর সাধারণ মানুষ। মেহনতি মানুষ। অর্থাৎ কৃষকেরা কৃষির ফলন বাড়াচ্ছেন। প্রবাসী শ্রমিকেরা বাইরে থেকে টাকা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। গার্মেন্ট শ্রমিকেরা নিরলস পরিশ্রম করে পোশাক খাতকে ধরে রেখেছেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করছেন। বরং শিক্ষিত ধনীরা দেশের অর্থ লুটপাট করছেন। তারা দেশের সম্পদ বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উৎপাদন করার যে সৃজনশীলতা, তা থেমে যায়নি। এ কারণেই বাংলাদেশের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অগ্রগ্রতি সারা বিশ্বে এখন ঈর্ষণীয় ব্যাপার। উন্নয়নে শেখ হাসিনার মডেল নিয়ে গবেষণাও করছে বিশ্বের অনেক দেশ। তার নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তবে উন্নয়নের জন্য বিরোধী দল দমন পীড়নের অভিযোগ সত্য নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের অপকর্মের জন্য দুর্বল বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। অপরাজনীতির কারণে দেশের জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগ উন্নয়ন ও গণতন্ত্র দুটোতেই বিশ্বাসী।
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন সারা বিশ্বের বিস্ময়। তিনি নন, বরং তাকেই অনুসরণ করছে বিশ্বের উন্নয়নমুখী দেশগুলো। দেশের আপামর জনগণ শেখ হাসিনার উন্নয়নের রাজনীতির সাথে আছেন। তারা যে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে নেই সেটি গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রমাণ দিয়েছেন। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা। আর সরকার কখনোই বিরোধীদের দমনে বিশ্বাস করে না। দেশের আপামর জনগণের মত ও চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েই কাজ করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বিএনপি জোট যদি সুস্থ রাজনীতিতে ফিরে আসে তবে জনমত নিয়ে তারাও আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন